অলীক দাস্তান



|| সায়ন্তন ঠাকুর ||

গরম ভাতের গন্ধ

বছরে একবার তায়েব মিঞা কটা গোরুর গাড়ি বোঝাই নতুন ধান নিয়ে এসে হাজির হয়। অঘ্রাণ মাসের মাঝামাঝি, পাতলা কুয়াশার স্তর পার হয়ে সন্ধের মুখে আমাদের বারবাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায় পাঁচ সাতটা জোয়ান বলদ টানা গাড়ি। গাড়ির নীচে হ্যারিকেন ঝোলানো। তখনও বাড়ির বাণেশ্বর শিবের থানে সন্ধে প্রদীপ জ্বলেনি। বেজে ওঠেনি শাঁখ। বলদগুলোকে জোয়াল থেকে ছাড়িয়ে উঠোনের খুঁটিতে বেঁধে দেয় তায়েব চাচা। গলা তুলে হেঁকে বলে,
উ মঈন,বলদ গুলানকে দু আঁটি খড় দিনি,বাপ আমার।
হা ক্লান্ত বলদগুলো ঝিমোতে থাকে। সেই কোন সকালে ঘর থেকে বেরিয়েছে। পথ তো কম নয়। বিশ মাইল। গঙ্গার পুব পারে পুরনো গঞ্জ মাণিক্যহার। এখানকার লোকে বলে মানকেহার। আছেন আমাদের বংশের কুলদেবতা গিরিধারী। চারশো বছরের মন্দির। পুরনো খিলান,নাটমন্দির,বাস্তুভিটে। কতদিন সংস্কার হয়নি ওই ভিটে। জংলা আগাছা,বুনো লতা,অশ্বথের চারা বাংলা ইঁটের দেওয়াল ফাটিয়ে মুখ তুলেছে আকাশের দিকে। এমন অঘ্রাণের সন্ধেয় আবছা কুয়াশায় ঢেকে যায় তারা। দৃশ্যমান জগতের ওপার থেকে যেন ভেসে আসে গিরিধারীর আরতির কাঁসর ঘন্টার শব্দ।
জমিজমা সব কিনেছিলেন বাবার দাদু। বেশিরভাগই দেবোত্তর সম্পত্তি। কিছু ধানি জমি ঘরের সারা বছরের চাল জোগায়। সে সব জমিজিরেত তায়েব চাচা চাষবাস করে। নতুন ধান উঠলে বস্তা বোঝাই করে নিয়ে আসে। সে ধান জমা থাকে আমাদের গোলায়। খড় ছাওয়া মাটির উঁচু গোলা। আলকাতরা মাখানো একখানি ছোট কালো দরজা তার মুখে। নতুন খেজুর গুড়ও আনে চাচানরম কড়াইশুঁটি। ফুলো ফুলো লাল মুড়ি কড়াইশুঁটি আর নতুন গুড় কাঁসার বড় জামবাটিতে মেখে খেতে দেয় মা।

তায়েবচাচা নিজের গামছাখান কাঁধে নিয়ে উঠোনে বসে।একটা বিড়ি ধরায়। আমাকে দেখতে পেয়ে হাত তুলে ইশারায় ডাকে। জিগ্যেস করে
পড়ানেখা চলছি দাঠাকুর ?
চলছে।একটু সলজ্জ হাসি আমি।
পড়ানেখা করি অনেক বড় হও দাঠাকুর। বংশির মান রাখতি হবে তুমাকে।
যেন কতদিনের চেনা। হেমন্তের কুয়াশা আর নতুন ধানের গন্ধে মাখামাখি এক সন্ধে নেমে এসেছে তখন চারপাশে।বাড়ির পিছনের বাগানে বুড়ো জামরুল গাছের তলায় জমেছে ঝুঁঝকো আঁধার। বাতাবি লেবু, তেজপাতা, উঁচু উঁচু নারকেল গাছ সারাদিনের ব্যস্ততার পর ক্লান্ত শরীরে নিথর দাঁড়িয়ে। পুকুর থেকে উঠে আসা বাতাসে শীতের শিরশিরানি। একটা লক্ষী প্যাঁচা প্রতিদিন ঠি ক এই সময় কোথা থেকে উড়ে এসে বাড়ির কার্ণিশে বসে। তারপর ডাকতে ডাকতে ওই বাঁশঝাড়ের দিকে উড়ে যায় ফের। জ্বলে ওঠে বাণেশ্বর শিবের থানে প্রদীপ। আমাদের বাড়ির অধিষ্ঠিত দেব। তাঁর নামেই এই বাস্তু। বংশ পাহারা দেন নাকি তিনিই। রুপোর চাঁদ তাঁর মাথায়। চোত মাসে মানত করা কত সন্নিসি আসে আমাদের বাড়ি। গাছের প্রথম আম, বেল দিয়ে যায়। এই সন্ধের মুখে কত শব্দ শোনা যায় পুরনো বাড়ির দরদালানে। ফিসফিস করে কারা যেন কথা বলে। কতদিনের মায়া,ছেড়ে যাওয়া কি সহজ ?

ঠাকুমা একটা লণ্ঠন নিয়ে এগিয়ে আসেন। তায়েব চাচা তাড়াতাড়ি বিড়ি ফেলে উঠে দাঁড়ায়। গড় হয়ে পেন্নাম করে ঠাকুমাকে দূর থেকে। ঠাকুমার আঁচলের পাশে আমি।
কেমন আছো তায়েব ?
মা ঠাকরুণের দয়ায় চলি যিছি গো!একমুখ হাসি ঝরে পড়ে কাঁচা পাকা দাড়ির ওপর।
এবার ধান কেমন ?
তা ধরিন ক্যানে বিশ মণ হবেক!
একটু চুপ করে থেকে ঠাকুমা বলে
বসো,ভেতর বাড়ি থেকে সিধে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এই বাড়ির নিয়ম। ভেতর থেকে চাল মুসুর ডাল আলু পেঁয়াজ আর লঙ্কা ধামায় করে দিয়ে যাবে কাজের বৌ। আর কিছু শুকনো কাঠ। মাটির উনোন বানিয়ে বারবাড়ির উঠোনে রান্না বসাবে তায়েব চাচার দল। ভাত, পাতলা মুসুর ডাল লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে আর ঝাল ঝাল আলু সেদ্ধ মাখা। রাত আরও ঘন হবে। শীতের রাত। আগুনের পাশে গোল হয়ে ওরা গল্প করবে। মাঠের গল্প,হালের বলদের গল্প,গাভীর গরম হওয়ার গল্প। বীজতলা আর ধান। কুয়াশা পার করা একটা জীবন।

মা তখন আমাকে জোর করে নিয়ে যাবে ভেতরে। খাইয়ে ঠাকুমার পাশে শুইয়ে দেবে। নিভু নিভু আলোয় ঘরের দেওয়ালে পাখা মেলে উড়ে যাবে পক্ষীরাজ। সুয়োরাণী দুয়োরাণী,অভিমানী কঙ্কাবতী। ছুটে আসবে ডাকাতের দল। ওই বুড়ো জামরুল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নীলকমল। লালকমলের আগে কে জাগে ? কে জাগে ?

উত্তর আসে না। শুধু পুকুর থেকে উঠে আসা শীত বাতাসে মিশে যায় তায়েব মিঞার গরম ভাতের গন্ধ। মুসুর ডালের গন্ধ। পুরনো দমচাপা বাড়ির দরদালানে আজও পাক খেয়ে মরে সে বাতাস। কার্ণিশে বড় হয় অশ্বথের চারা। ধুলোময় উঠোন। ভেঙে গেছে ধানের গোলা। কেউ নেই তাদের। কেউ কোথাও নেই।


ভুলোর চর

গাড়ির নীচে দুলছে মৃদু আলোর বাক্স। চৌকো চারকেঁচের ভেতর সুতোর পলতে। পরিস্কার করে মাজা চারধারের কাঁচ।কাঠের বড় বড় দুটো চাকা। ওপরে যত্ন করে লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়েছিল বৃন্দাবন কামার। দুটো জোয়ান বলদ টানছে গাড়ি। সেই গেল বছর বোশেখ মাসে চক মজিদপুরের হাট থেকে বলদ দুটো কিনেছিল সনাতন। চাষার ব্যাটা সনাতন। শিবের থান পার হয়ে খালের পাশে একলপ্তে সাড়ে তিন কাঠা ধানি জমিও আছে। বাপ নিবারণ মরার আগে জমি দেখিয়ে বলেছিল
--গতর খাটালি ভাতির জোগান লিয়ে ভাবতি হবেক লায় তুর!

তা ভাতের অভাব নাই সনাতনের। জোয়ান মদ্দ ব্যাটার কাজ করে বলদ দুটো। যত্নও করে সে। খোল গমের ভূষি চিটে গুড় নিজের হাতে মেখে পাতনা ভরে খেতে দেয় দুবেলা। হাওরে নিয়ে গিয়ে গা ধুয়ে দেয়। সন্ধে হলে মশার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সাঁজাল দেয় প্রতিদিন গোয়াল ঘরে। দিনে মাঠের কাজ আর রাতে কোনওদিন সওয়ারি পেলে গাড়িটা জুতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

আজ ছই লাগিয়েছে গাড়ির ওপর। কাঁথা পেতে দিয়েছে ভেতরে। নীচে চারকেঁচের আলোর টুকরো হলুদ অস্পষ্ট  ইশারা তৈরি করছে পথের ওপর। বলদ দুটোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে আগে আগে হেঁটে চলেছে। তাদের গলার ঘন্টির টুংটাং শব্দ যেন অনুসরণ করছে সেই ছায়া শরীরদের। আজ বিশ্বেশ্বর পালের মেয়ে সৌদামিনী আর জামাই নরেশ চলেছে সনাতনের গাড়িতে। বিশ্বেশ্বর শাঁসালো খদ্দের, গঞ্জে চালের আড়ত আছে। কড়কড়ে দুশো টাকা দিয়েছে সনাতনকে, ভোর হওয়ার আগেই তাদের মতিগঞ্জের খেয়াঘাটে পৌঁছে দিতে হবে। মাইল দশেকের পথ। ভোর ভোর খেয়া ছাড়বে। ওপারের আংড়াঘাটা ইস্টিশান থেকে রেল ধরবে নরেশ আর সৌদামিনী। সৌদামিনী, সদুকে সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছে সনাতন। গাঁয়ের মেয়ে। কত খেলা করেছে কোলে পিঠে। সেই অষ্টমঙ্গলার পর এই এল গাঁয়ে,দুবছর পর,দশদিন থেকে আজ ফিরে যাচ্ছে।

অঘ্রাণ মাসের রাত। একাদশীর চাঁদ আবছা আলোয় ভরিয়ে রেখেছে চরাচর। হিম হিম কুয়াশার চাদরে সে আলো কিছুটা বা ফ্যাকাশে। গেল হপ্তা লবান ছিল। ধান কেটে খাঁ খাঁ করছে মাঠ। আদিগন্ত বিধবার সাদা থানের মতো জেগে আছে। ভুতুড়ে এক নিরালম্ব কুয়াশা ঘিরে ধরেছে চারপাশ। এগিয়ে চলেছে সনাতনের গাড়ি। টি টি করে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল কী এক রাতচরা পাখি। নিশুত রাত। মাঝে মাঝে নরেশ আর সৌদামিনীর চাপা হাসির শব্দ শুধু জেগে আছে নবান্নের প্রান্তরে। একসারি সুপুরি গাছের মধ্যে দিয়ে সরু রাস্তা। আরেকটু এগোলেই ভুলোর চর। সৌদামিনী ছইএর ভেতর থেকে গলা তুলে জিগ্যেস করে
-
কাকা, ভুলোর চর আসছি, লয় ? কিছু হবেক লাই তো ?
গলা খাঁকারি দিয়ে সনাতন একটু চুপ করে থেকে বলে
-
ডর লাই গো মা! মুই থাকতি ডর কি তুমার !

অঞ্জনা নদীর পুরোনো চরে বালি আর বালি। জোছনার মরা আলোয় চিকচিক করছে এখন। ক্ষয়ে যাওয়া কাশের ঝোঁপ এখনও কিছু বেঁচে আছে। তার মাঝখান দিয়ে সরু বাঁধ আর রাস্তা। সেই কোনকালে অঞ্জনা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে, ফেলে রেখে গেছে আদিগন্ত বালির সমুদ্র। ভুলোর চর। লোকে বলে গহীন রাতে পথ ভুলে মানুষ গোলকধাঁধায় ঘুরে মরে। পরদিন সকালে চরার ওপর পরে থাকে হা ক্লান্ত মানুষটার মরা কাঠের মতো শরীর। রোদ্দুরের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় মুখে গ্যাঁজলার দাগ। কী এক বাতাস শিসের শব্দ তুলে পাক খেয়ে ঘুরে মরছে এখন। অস্পষ্ট কুয়াশায় শুধু সনাতনের গাড়ির হলুদ নিস্তেজ আলো। চরের ওপর এক প্রকাণ্ড অশ্বথ গাছ হাত পা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। কবেকার ঝুরি নেমেছে চারপাশে। এককালে অঞ্জনা নদীর সঙ্গে নাকি যোগ ছিল গাঙুরের। হয়তো বেহুলার ডিঙা ভেসে গিয়েছিল। লখিন্দরের মরা ছুঁয়ে ভেসে বেড়ানো কান্না এখনও যেন থমকে আছে ভুলোর চরে। কান পাতলে শোনা যায় এমন চাঁদের রাতে।

চর পার না হতেই খোলা গলায় নরেশ গান ধরে। ভারী মিষ্টি গলা ছেলেটার। সনাতন নিজের মনেই একটু হেসে ওঠে। বোষ্টুমদের গান। বনমালী যেন পরজনমে রাধা হয়! ধূ ধূ চরে অনেকদিন পর পাক খেয়ে ওঠে সুর। জোছনা যেন একটু গাঢ় হয় পিরীতের গানে! বলদ দুটোর গলার টুংটাং শব্দ যেন একতারা। অনেক দূর থেকে দেখা যায় একখানি হলুদ আলোর টুকরো ভেসে যাচ্ছে কুয়াশা ভেদ করে দুজন কলহাস্যমুখর যুবক যুবতীর প্রেম সম্বল করে।

সনাতনের পুঁটির কথা মনে পড়ছে। তার মেয়ে। দশবছর হয়ে গেল ধুতরোর বীজ বেঁটে খেয়ে মরেছে। বিয়েও দিয়েছিল দু কাঠা জমি আর হালের বলদ বেচে। ছেলে হয় না বলে বাঁজা মেয়েমানুষের কাছে ছিল শুধু ধুতরোর বীজ। আজ বেঁচে থাকলে সৌদামিনীর মতোই হতো।অদৃশ্য কোন জগত থেকে হয়তো আজ পুঁটি, মালতীমালা নামটা ভুলেই গেছে সবাই,শুনছে ওই পিরীতের গান। পরজনমে রাধা হয় যেন বনমালী। বেহুলা আজও হয়তো তার ডিঙা বাইছে ওই গানের সুরে। কোন জন্মের হেমন্তের জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। নক্ষত্রলোক থেকে টুপটাপ খসে পড়ছে কত অতৃপ্তি কত চোখের জল এই মরপৃথিবীর বুকে। আবার ধুয়েও যাচ্ছে নরেশের গানে। আজ এই নিশুত রাতে ওই গান যেন কোনও তর্পণের মন্ত্র। শান্তিজল।

দুটো অল্পবয়সী ভালবাসাকে বুকে নিয়ে ভুলোর চর পার হয়ে যাচ্ছে সনাতনের গাড়ি। হলুদ আলোর টুকরো রেখে যাচ্ছে তার স্মৃতিচিহ্ন।


হোটেল মোমো-হাট

মাছের ডিমের বড়ার ঝোল,আলুভাজা আর ভাত।চোদ্দ টাকা। মোমো হাট কিন্তু সেসব দিনে মোমো শুধু খেত হয় ম্যালের সেই বেঞ্চে বসে।যেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমায় করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় একা এসে বসেছিলেন। আর কুয়াশায় ভেসে গিয়েছিল চরাচর। তখনও ব্লু পপি নেই,ওয়াও মোমো নেই,সুইগি নেই,ওলা উবের কিচ্ছু নেই। আছে পাড়ার দোকানে সবুজ চিলিসস মাখানো এগ আলুর রোল। হাফপ্লেট চাউমিন। বেগুনি। পেঁয়াজি।

দমদম স্টেশনের চার নাম্বার প্ল্যাটফর্ম পার হয়ে অনেকটা এগিয়ে আসতে হত। আগাছায় ঢাকা রেললাইনের পাশ দিয়ে একটা রোগা রাস্তা। নীচু হয়ে নেমে গেছে ভাঙা লোহার সিঁড়ি। তার হাতল জড়িয়ে রেখেছে কী এক বুনো আগাছা। তখনও জ্বলে ওঠেনি দুপাশে ফ্ল্যাটবাড়ির আলো। তখনও জমজমাট সিপিএমের দমদম জোনাল অফিস। মফস্বলের অন্ধকার চাপ বেঁধে পড়ে থাকে গলির মুখে। ওই ভাঙা সিঁড়ির নীচে মোমবাতির আলোয় নীল প্লাস্টিক পেতে মাছ নিয়ে বসে হারাণদা। শক্ত পোক্ত সাজোয়ান চেহারা, কালো শিরা ওঠা চামড়া, হলদে চোখ। হেঁটো ধুতি আর সাদা গেঞ্জি। পুঁটি,মৌরলা,ছোট ছোট চারাপোনা সব সস্তার মাছ। পিছনে বন্ধ এক কারখানার ইঁট বার করা দেওয়াল। কবেকার পোস্টারে লেগে থাকে কতগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ,আমাদের লড়াই চলছে,চলবে! একটা বুড়ো নিম গাছ কিছু হাওয়া বয়ে আনে।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলেই হারাণদা ডাক দেয়। পাশে গিয়ে বসি। একটা টাটকা বিড়ি এগিয়ে ধরে আমার দিকে। কোনও দিন মেঘের বাতাস ধেয়ে আসে। জলের গন্ধ মিশে যায় আঁশটে গন্ধের শরীরে। আমাকে জিগ্যেস করে
লিবা নাকি মৌরুলা ?
নিই একেক দিন। সেদিন মাছের পেট পরিস্কার করতে করতে হারাণদা বলে
পথ্থমে তেলে ভেজে লিবা মাছ। বেশি ভাজবা না তাই বলি। আলু বেগুন কাটবা ফালি ফালি...
আমি শুনে যাই। হারাণ মোল্লার দেশের গল্প শুনি। কত পুকুর আর ছায়া। স্বচ্ছ টলটলে জলের নীচে খেলে বেড়ায় সব কবেকার মাছ। জোছনায় ঘাই মেরে ওঠে। ছিপের গল্প বলে। কতরকম বড়শি আর ছিপ। পুরনো চালের কুঁড়ো আর পিপড়ের ডিম মেখে চার তৈরী হয়। সে নাকি অব্যর্থ। যখন আকাশ কালো করে ছুটে আসে মেঘের দল, ঝিরঝির বৃষ্টি দোলা খায় বাতাসে, তখন নাকি ওই চারের গন্ধে ছুটে আসে মাছের দল। আমিও শোনাই আমার দেশের গল্প। মাঠের ওপর ভেসে থাকা রোদ্দুরের গল্প। লবাণের সময় নতুন ধান আর কুয়াশায় জেগে ওঠা আলো। বড়ি,শাক,কুমড়ো ভাজা, নারকেল ভাজা। নতুন চালের ভাতমুগের ডাল। পোস্তর বড়া। দুজন মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া দেশের গল্প করে। নিমফুল ঝরে পড়ে তাদের ওপর। বাতাস বয়ে যায়। অস্পষ্ট মোমের হলুদ আলোয় সব একাকার হয়ে যায়।

আরেকটু এগোলেই আমার ভাড়া বাড়ি। কচুরি পানা জঙ্গলে ঘেরা পুকুর পার হয়ে, ঝোঁপঝাড় ভেদ করে ভাঙা পাঁচিলের পাশে সেই সবুজ জানলার ঘর। একটু দূরে উঠোনের ওপর রান্নাঘর। কেরোসিনের স্টোভ। কালো লোহার কড়াই। উঠোনে বাতাবি লেবু, নয়নতারা গাছ। হাঁসের ডিম রাঁধি। একেকদিন মুরগীর মেটে, গলা, গিজার্ডের চচ্চড়ি। ঘর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যায়। গ্লাসে অনেকটা রাম আর অল্প জল মিশিয়ে অপেক্ষা করে সুমিতেশ সরকার। গলা তুলে চিৎকার করে বলে,
শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়েছিস তো ?
আমাকে যত্ন করে রান্না শেখায়। তেল আর মশলার হিসাব। লইট্যা মাছের ঝুরো। লাউএর খোসা ভাজা। মানবাটা। বাজারে কানা বেগুন আর চকচকে হাইব্রিড বেগুনের তফাত। চর্বিওয়ালা খাসির সিনা কেনার কৌশল। ওই ছোট ঘরের তক্তাপোশে একেকদিন রাত ঘন হলে বলে,
মৃদুল দাশগুপ্ত পড়েছিস ? সুব্রত সরকার ? কেদার রাজা ?
চোখদুটো ছলছল করে সেসময়। ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে থাকেন ভাস্কর চক্রবর্তী। আমার হাতে সদ্য বের হওয়া সুমিতেশদার কবিতার বই, দশ লাইন স্তব্ধতা। এক পাঁইট খেয়ে লিখে দিয়েছিল,
“সায়ন্তন, ব্যাপারটা অ্যাকচুয়ালি এইরকমই”!
বলে উঠেছিল
কেউ পড়বে না আমার লেখা দেখিস।
তখনই কি প্রকাণ্ড অপরাজেয় ওই কাঁকড়া থাবা বসিয়েছিল সুমিতেশদার মুখগহ্বরে ? কাঁকড়ার ঝাল খেয়েছিলাম এক রবিবারের দুপুরে। সুমিতেশদা রান্না করেছিল। সেসব কোন যুগ যেন। তামাদি হলুদ এক সময়ের দলিল।

অনিন্দ্য আসে প্রায় প্রতি মঙ্গলবার। চপ কিনি। মুড়ি। নাটকের দলে কী হল শুনি। রোগা ছিপছিপে ছেলেটা সেই মহিম হালদার স্ট্রি ট থেকে ছুটে ছুটে আসে। তিয়ার গল্প শোনায়। জয়তীর মুক্তো অক্ষরে পাঠানো চিঠি দেখায়। আমি একজন লম্বা মেয়ের কথা বলি। গ্ল্যাডিওলা হাতে মাঝদুপুরে যে বেল বাজাত। ডং শব্দে ভেসে আসত অনন্তের ছায়া। গলা তুলে অনিন্দ্যকে বলি,কেন শুধু চলে যেতে চাও ? থেকে যাও থেকে যাও থেকে যাও তুমি! অবাস্তব ওই ঘরে সেসব তখন আমার লেখা। বাংলা ভাষায় আদি থেকে অন্ত যা লেখা হয়েছে, সব আমার, সব আমার।

এখন মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, ওই ঘর ওই সময় আদৌ ছিল ? নব্বই সালে সত্যি কবিতা লিখতেন সুমিতেশ সরকার ? বাপ্পা রেডিও দোকানের গলির ফ্ল্যাট। দেনা ব্যাঙ্কের অফিসার। কে জানে! অনিন্দ্যর সঙ্গে কতদিন দেখা হয় না। সুমিতেশদার সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল, তাও বছর দশেক হয়ে গেল। তারপর তার কুয়াশা বিলম্বিত এক্কাগাড়ি চলে গেছে কুসুমডুংরির আউটার চেকপোস্ট পার হয়ে। চিরপ্রণম্য আগুন টেনে নিয়ে গেছে তাকে।

মোবাইল নেই, ফেসবুক নেই, শপিং মল নেই, সরু সরু গলি রাস্তার দমদম। কিছু ছোট কাগজ। সেরেজা পুস্তানিহীন এক জীবনতখনও ভালবাসার রঙ লাল।একটা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় ১৩৮ পূর্ব সিঁথি রোড। জমা জলে ছটফটে বাইক। নটরাজ রোল সেন্টারের মোগলাই। হাফ চিলি চিকেন। কিছুই বোধহয় নষ্ট হয় না।সেই সতরঞ্চিটা এখনও আছে। যেটা বেঁধে তোশক নরম বালিশ নিয়ে একদিন এসেছিলাম এই বুড়ো শহরে। সেদিনও বুধবার ছিল। মেঘ করে এসেছিল খুব। একটা দামাল হাওয়া ছুটে এসেছিল কোথা থেকে। আজও বয়। খুলে দেয় কবেকার বাক্স। কে যেন বলে ওঠে
আজ যে ভাষায় কথা বলছি, তার নাম বাঙলা ভাষা”!


হটিনগর নিম্ন বুনিয়াদি প্রাথমিক বিদ্যালয়

রাঢ়দেশের এক অখ্যাত প্রাইমারি স্কুল। বুনো আগাছা, বিছুটি পাতার ঝোঁপ,ঘন ছায়া বিছিয়ে রাখা কালোজাম গাছের মাঝে ইঁট বার করা পাঁচটি ঘর। বড় বড় জানলা। টানা বারান্দা। বালি খরখরে সিমেন্টের মেঝে। আর সামনে অপর্যাপ্ত মাঠ। বর্ষার ঘন নরম সবুজ ঘাসে ছাওয়া। তার কিনারে কয়েকটা মেটে ঘর,ভিজে কালো খড়ের চালা। পার হয়ে পিচ ঢালাই রাজ্য সড়ক একখানি শান্ত নদীর মতো বয়ে গেছে। ওপাশে ধূ ধূ ধানি জমি, লকলক করছে নতুন ধানের শিষ। প্রকাণ্ড বট গাছ একা একা দাঁড়িয়ে আছে। পুরনো শাখা প্রশাখায় ঝুপসি অাঁধার দিনমানেও । আকাশে আষাঢ় বেলা। কোন বাড়ির ছোটবউ সেই কবে গলায় দড়ি দিয়েছিল ওই ঝুঁকে আসা মোটা ডালে। নিস্তব্ধ চরাচরে শিথিল লালপেড়ে হলুদ শাড়ি আর দুখানি আলতা মাখা পা দোলা খেয়েছিল হয়তো সেদিন।জোলো বাতাস ধেয়ে আসছে আরও কিছু দূরের ঘোলা জলের হাওড় থেকে। পুঁটি, খলসে, মৌরালা মাছের লোভে স্কুল ছুটি হওয়া ছেলের দল ভিড় জমাবে। গামছা পেতে মাছ ধরবে। খলবল করে উঠবে মাছের দল। মেঘলা আকাশের নীচে চকচক করবে গায়ের আঁশ। দুপুরে ভাতের পাতে মাছের টক, কুমড়ো বেগুনের ঘ্যাঁট। মুনিষ খেটে, ধান রুইয়ে, ভাগের পুকুরের মাছ ধরে সেই বেলা করে বাড়ি ফিরবে ছেলেদের বাবারা। চামড়া জড়োজড়ো সারাদিন বৃষ্টি ভিজে। এরই মাঝে ইস্কুলের বদ্যি মাস্টার পড়িয়ে চলেন কিশলয়। কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল, কোন দেশেতে চলতে গেলে দলতে হয় রে দূর্বা কোমল ?! খোলা জানলা বেয়ে হুটোপুটি খায় সজল মেঘের ছায়া। বেঞ্চ নেই, চট পেতে বসে আছে একপাল ছেলেমেয়ে। মেয়েরা ডানদিকে আর ছেলেরা বাঁদিকে। গোলাপি ফ্রক পরে ঝাঁকড়া চুলের বাচ্চা ওই যে মেয়েটা, বোবা, কথা বলতে পারে না। বেশ স্বচ্ছল ঘরের অবস্থা। শুধু কালো চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে। অনেক বছর পরেও ছেলেটা বহু নো স্মাজ কাজল, ঘন আই শ্যাডো, মাস্কারা পার হয়েও ওই চোখ দুটো ভুলতে পারে না। ছায়া ঘনাইছে বনে বনে গানটা মনে আসে তার বারবার। ইস্কুল ছুটি হবে আর কিছুক্ষণ পরেই। তার আগে খেসারির ডাল আর আধভাঙা চালের খিচুড়ি খাওয়া হবে। ঢং ঢং করে বাজবে স্কুলের ঘন্টা।বাক্সে আসন গুটিয়ে বই খাতা শ্লেট পুরে বাড়ির রাস্তা ধরবে ছেলেটা। আজ শান্ত, নিখিল, হারু তার সঙ্গে ফিরবে না। ওরা গামছা পেতে হাওড়ে মাছ ধরতে যাবে। ছেলেটার ভালো লাগে না এত হইচই। সবুজ ধানি মাঠের মাঝখানে পড়ে থাকা আলপথ ধরে বাড়ি ফিরবে সে। একা। সাদা জামা, নীল হাফ প্যান্ট। মাথার ওপর আষাঢ়ের থম ধরা আকাশ। মেঘের ওপর আরও মেঘের স্তূপ আলের ঘাস নুয়ে পড়ছে এলোমেলো বাতাসে। চন্দ্রবোড়ার ভয় পার হয়ে সে বাড়ি ফিরছে। কী এক অনির্দিষ্ট আনন্দে তার মন ভরে উঠছে। অকারণে। এত তুচ্ছ এত সামান্য আবার কী অপূর্ব ! এমন সময়ে সেই তাঁর সঙ্গে ছেলেটার দেখা হয়। তিনি মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন, এই অনিশ্চিত অনির্দিষ্ট পথেই কেটে যাবে তোমার এই জন্ম। সব অপমান আর কষ্টের শেষে এমন ধানি মাঠ আর মেঘভরা আকাশই আমি সাজিয়ে রাখব তোমার জন্য আজীবন। এক অহেতুক আনন্দ আগলে রাখবে তোমাকে।


পার্বতী হোটেল

দেওয়ালে একটা আয়তকার ব্ল্যাকবোর্ড। চক খড়ির আঁচড়ে লেখা,ভাত,মুগের ডাল,আলুভাজা,এঁচোড়ের তরকারি,কাতলা কালিয়া,কাতলা জিরে বাটা ঝোল,সর্ষে পাবদা,আরও কত খাবারের টাটকা গন্ধ। ভেতরের ঘর থেকে সে গন্ধ বয়ে আনা বাতাস মিশে যায় উঁচু কড়ি বরগার সিলিংএ ঝুলে থাকা ডিসি ফ্যানের মন্থর বাতাসে। একটা লম্বাটে ঘর। দেওয়ালের দিকে মুখ করে দুপাশে লম্বা খয়েরি রঙা টেবিল আর একটু নীচু বেঞ্চ। যেমন আমাদের স্কুলে থাকত অনেকদিন আগে। শেষপ্রান্তে দু ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে আবার একটা ছোট বেঞ্চ আর টেবিল। ঘরে ঢোকার মুখে সাবেক কালের চৌকাঠ, উঁচু দরজা তার মাথায় ময়লা জাফরি, কাঠের রঙ কি অস্পষ্ট সবুজ ? নাকি হলদে ? এখন আর মনে পড়ে না ভালো। ডানহাতে ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে আছেন এক প্রৌঢ়। মাথার সামনের চুল কমে এসেছে, পরিস্কার কামানো মুখ, পরিচ্ছন্ন হাতা গোটানো ফুল শার্ট আর ধুতি। পিছনের দেওয়ালে বামা ক্ষ্যাপা জড়িয়ে ধরে আছেন লোলজিহ্বা তাঁর মা কে। টাটকা জবার মালায় সেই দুপুরেও জলের ফোঁটা লেগে থাকত।

বাইরে আগুনের হলকা, চৈত্র মাসের দুপুরে দু একটা শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় বিবাগী বাতাস। দক্ষিণ কলকাতার ছায়া ছায়া সব রাস্তা। সদানন্দ রোড, মহিম হালদার স্ট্রি ট, হরিশ পার্কের সামনের গলি।কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়ার পাতা ছাওয়া পিচের পথ। একটু অবাস্তব। অন্য কোনও জগতের দরজা যেন একটু খোলা ওইসব দুপুরের শরীরে। দুজন অল্পবয়স্ক ছেলে হেঁটে বেড়ায় নিজেদের ছায়া ফেলে সেখানে। রোগা, দীর্ঘকায়, অপরজন ভারী সুন্দর দেখতে, কী এক নরম লাবণ্য সারা মুখে! ওই বিবাগী বাতাসের কথা তারা দুজনেই জানে। তাদের দেশে গঙ্গার জলে ওই বাতাস স্রোত তুলে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। ভাটফুল আর বুনো আকন্দে ছেয়ে থাকে পথ। লাল শালু গায়ে জড়িয়ে সিধে চেয়ে বেড়ায় গাজনের সন্নিসীরা। লাল ধুলো ঢেকে যায় চরাচর। আর থাকে ওই বাতাস। হাহাকারের মতো ফুটি ফাটা মাঠে, বট গাছের ছায়ায়, জল শুকিয়ে যাওয়া ভাগের পুকুরে সে ঘুরে বেড়ায়। পরনে সস্তার বাঘছাল, হাতে মরচে ধরা ত্রিশুল , বাঁকা প্লাস্টিকের চাঁদ মাথায়, রুখু চুল। একমুখ হাসি।

ছেলেদুটো ঘুরে বেড়ায়। একপেট যুবক দামাল খিদে নিয়ে এই প্রাচীন শহরের রাস্তায় উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়ায়। পিছু পিছু ধাওয়া করে ওই বাতাস। পার্বতী হোটেলে ভাত,ডাল আর সবজি ভাত থালায় নিয়ে পিপাসার্ত তাকিয়ে থাকে রুই মাছের কালিয়া, চিতল পেটি বা খাসির ঝোলের বাটির দিকে। নিজেদের মধ্যে বলে, টাকা রোজগার করে একদিন খাব দুজনে! তখন রোদ পড়ে এসেছে, লম্বা হয়েছে নিজেদের ছায়া, নাটক আর কবিতার প্রহর বিস্তার করতে শুরু করেছে নিজেদের মায়া। সতেজ কলাপাতা ঢাকা ভাতের থালা, একটু লবণ, মাটির ভাঁড়ে ঠাণ্ডা জল, চারপাশে সাজানো তরকারি, লম্বা একবিঘত কাতলা পেটির কালিয়া, অনাগত সেই টাকা পয়সাওলা দিনের গন্ধ ছেলেদুটোকে স্বপ্ন দেখায়। সেসব এক বাতিল পুড়ে যাওয়া সময়ের গল্প।

কত চৈত্র শেষ হয়েছে তারপর, কত বিবাগী বাতাস গেরুয়া কাপড় পরে ছুটে গেছে দিকচক্রবাল রেখার দিকে, জমি জিরেত বিক্রি হয়েছে, ফ্ল্যাট বাড়ির দালান হয়েছে একফালি ঠাণ্ডা ঘরে আস্তানা জুটেছে উদ্বাস্তু ছেলে দুটোর। রক্তে ভাসমান স্নেহের কণা বেড়েছে আর প্রেমিকারা ছেড়ে চলে গেছে অবলীলায়। রামের গ্লাসে ছায়া পড়েছে অন্য পৃথিবীর। শুধু পার্বতী হোটেলের ওই ভাতের থালা, একবিঘত কাতলা পেটির কালিয়া, খাসির লাল ঝোল, একটু লবণ, জল ছেটানো সতেজ কলাপাতা আর হয়নি কখনও। আজ যখন কেউ জিগ্যেস করে, কোথায় থাকেন, ভারী অবাক হয়ে ভাবি কী বলব! এ কি আমার জায়গা? একফালি বারান্দা জুটে গেলেই কি বলা যায় বাড়ির ঠি কানা? লাল ধুলো, ওই হাহাকারময় চৈত্র বাতাসকত অঘ্রাণ মাসের হলদে বিকেল, বুনো পাতার গন্ধে ভারী হয়ে যাওয়া বাতাস, একটা শ্যাওলা মাখা উঠোন, বুড়ো জামরুল গাছ, অন্ধকার হয়ে আসা ঘাটের ধার আর বাঁশঝোঁপ, তারা কি বাড়ি নয়? তারা কি ওই ভাতের থালার মতোই স্বপ্নের অংশীদার নয়?

আজও যখন পকেটে পয়সা থাকে না, মনে পড়ে, একটা লম্বা ঘর, ভাতের গন্ধ, হেলে পড়া সাইনবোর্ড। ওই দুপুরের ছায়া মেখে আজও দুটো ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই শহরের দুই প্রাচীন উদ্বাস্তু। জমি জিরেত কাঁঠাল গাছের ছায়া ওই গেরুয়া রঙের বাতাস আর পার্বতী হোটেলের হারিয়ে যাওয়া ভাতের থালার খোঁজে তারা হেঁটে চলেছে। এক জীবন থেকে অন্য জীবন। সূর্যাস্তের দিকে। তারা হেঁটে চলেছে।

|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ২ || 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা