রূপকল্প



|| ইন্দ্রনীল ঘোষ ||




(শেষ পর্ব) 

রাজকন্যা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “হুম। তারপর বলো

মিশরে তখন হাতশেপসুত। মূর্তি দেখেছ? কী গম্ভীর! একটা জিনিস লক্ষ্য করবে, এরা সবাই কীরকম ভীষণ কঠোর মুখ-দেহভঙ্গি... নিখুঁত ভাবে সোজা হওয়ার চেষ্টা করছে... যেন মাপদণ্ড হয়ে উঠতে চাইছে... বা, জীবনের একক। আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, সভ্যতার সাথে সাথে মানুষ হাসতে শিখল, না-কি ভুলল?” খোসা ভাবে, কয়েক মুহূর্ত, বলে, “বোধহয় প্রথমটাই। আমরা, সময়ের সভ্য মানুষেরা প্রাচীন মানুষদের থেকে অনেক বেশি হাসতে পারি। সভ্যতার সাথে সাথে ধীরে ধীরে আমরা বুঝতে পেরেছি মাপদণ্ড বা একক... এই শব্দগুলোই অলীক এসৃষ্টিতে। আর তত হেসেছি... প্রাণ খুলে... ভিত কাঁপিয়ে।

আহ!রাজকন্যা চোখ কোঁচকায়, “কী বাজে বকছ? রবীন-পাখির খবরটা বলো না... ফ্লোরিডার সেই গাছটার... দ্য সেনেটর... তার কী হলো?”

পুড়ে গেছে।    

সে কি!আঁতকে ওঠে রাজকন্যা।

হ্যাঁ। পুড়ে গেছে। বা বলা ভালো, পুড়িয়ে দিয়েছে। এক ছাব্বিশ বছরের মহিলা, সারা বেনস... নেশায় ছিল...  ভোরের দিকে গাছের নিচে অন্ধকারে নেশা করছে... আলোর জন্য খানিকটা জংলা জ্বালিয়ে দিল, আর মুহূর্তের মধ্যে গোটা গাছ, সাড়ে তিন হাজার বছরের আঙুলের ছাপ... দাউদাউ করে... প্রহরীরা দেখল... চিমনির মতো, গাছের ভিতর থেকে আগুন বেরিয়ে আসছে।

তবে, রবীন পাখি?” ফাঁকা স্লেটের মতো তাকিয়ে থাকে রাজকন্যা।
এই ঘটনার পর আর কোনো খবর নেই। ওখানেই শেষ দেখা গেছিল।
দুজনেই চুপ। শান্ত বসে থাকে। নদীর ধারে পড়ে থাকা ব্লেড কুড়িয়ে, গুছিয়ে রাখে রাজকন্যা, বলে, “আমায় এবার ফিরতে হবে। তোমায় এই নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাই?”

উত্তর না দিয়ে ঘোরের মতো খোসা বলে চলে, “একটা সাড়ে তিন হাজার বছরের গাছ... ওভাবে শেষ হয়ে গেল! সাড়ে তিন হাজার বছরের আবহাওয়া-চিহ্ন... পৃথিবীর, মানুষের, সভ্যতার ছাপ... শেষ।

রবীন পাখি হয়ত আর কোনোদিন ফিরবে না।

নদীর আওয়াজে তাদের দীর্ঘশ্বাস প্রতিফলন হয়। যেন আয়ুর বিষাদে সন্ধে ছিটিয়ে দিচ্ছে চাষি। বিষাদের ফলন হবে, মাঠ ভরে উঠবে, আসছে অঘ্রাণে।

আচমকা হেসে ওঠে খোসা। চিৎকার করে বলে, “কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হবে না। ওরবীন দ্যাখো আরও পুরনো কোনো গাছে গিয়ে উঠেছে... কদিন বাদেই জানতে পারবে। 
রাজকন্যা অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।

তোমার মনে নেই, একবার ও বলেছিল, পৃথিবীর কোনো পুরনো গাছ মারা গেলে ও তার চেয়েও পুরনো একটা গাছ ঠিক খুঁজে বার করবে? মনে পড়ছে? এই গাছ খোঁজাটাই ওর নেশা রাজকন্যে। ও ঠিকই থাকবে।

দুচোখ আশ্বাসে ভরে হেসে ওঠে রাজকন্যা, “ঠিকই। ও না যাযাবর? ট্রাপিজের মতো এক আগুন লাগা গাছ থেকে ঝাঁপ দেবে আরো আরো বেঁচে থাকা গাছের দিকে...

থুতনিতে হাত রেখে কোনো এক দূরে, বোধহয় রবীন পাখির নতুন বানানো বাসার দিকে তাকিয়ে থাকে রাজকন্যা। এক মৃত গাছ থেকে আরেক মৃত গাছের মধ্যে যে বিস্তৃত সালোকসংশ্লেষ, সেখানেই উড়ন্ত টানা পাখি। রাজকন্যার মুখে, এখন, স্লেটে লেখা প্রথম স্বরবর্ণের ভাঁজ। জিজ্ঞেস করে, “পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো গাছ কোনটা, জানো?”

(সমাপ্ত) 

|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৮ (ধারাবাহিক) ||

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা