রূপকল্প
|| ইন্দ্রনীল ঘোষ ||
(প্রথম পর্বের পর)
রাজকন্যা তার হাত ঠেলে সরিয়ে দেয়।
বলে,
“এই জন্যেই আমি মরতে চাইছিলাম। কেউ আর আমাদের বিশ্বাসই করে না।
কারোর দরকারই নেই রূপকথায়। চোখের জল থেকে যে শিশির হতে পারে, হিংসা থেকে যে আগুন হয় – তা আজ আর কেউ মানেই না।
তোমরা আমাদের সঙ ভাবো। হাতি নিয়ে, ঘোড়া নিয়ে, ভাড়া করা পুরনো ঢঙের জামাকাপড় চড়িয়ে আমরা কিছু জোকার যেন রয়েছি তোমাদের
সভ্যতায়। নকল। অবিশ্বাস্য।”
“আরে না না... তা নয়... তা
নয়... বরং উলটো রাজকন্যে। আমার তো মনে হয় যদি কোথাও কোনো সত্যি ব’লে কিছু থেকে থাকে, তবে তা রূপকথাই। ভাবো না,
কোনো শ্বাসের রুগী। শ্বাস নিতে পারছে না। আর তাকে ঘিরে, তার বিছানার চারধারে ভিড় ক’রে আছে যেসব উদ্বিগ্ন
মানুষের দল — সঠিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে চলেছে... এটা রূপকথা
নয়? বা স্টেশনের ধারে প’ড়ে থাকা,
দিন-মজুর খাটা সেই কিশোরের কথা ভাবো, যার আজ
রাতে কোনো খাবার জোটেনি। এক বেঞ্চের নিচে কুঁকড়ে চাদর চাপা, খিদে
ভোলার জন্য যে নতুন শেখা হাত-মৈথুনের জাদুকে ডাকছে। রূপকথা নয়? কিংবা সেই মহিলার কথা ভাবো। যে ভেতর ঘরে বরের হাত থেকে বেদম মার খেয়ে
বাইরের ঘরে এসে পড়তে বসা মেয়ের মাথায় হাত বোলায়... বলে, এ ফর
অ্যাপেল বি ফর ব্যাট। ভাবো রাজকন্যে... এগুলো রূপকথা নয়? প্রতি
মুহূর্তের প্রাণ সে মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়... আর এই অসংখ্য প্রাণের দানার মধ্যে
দিয়েই তরঙ্গের মতো বয়ে চলি আমরা। প্রতি মুহূর্তে তৈরি হই, প্রতি
মুহূর্তে শেষ... আর যেখানে, যে বিন্দুতে প্রাণের এই কণারা
ধাক্কা খায়, তৈরি হয় রঙের বিভ্রম। সে-ই তো রূপকথা। আমাদের
অবয়ব, আমাদের বেঁচে থাকার ধারণাটাই তো রূপকথা।”
রাজকন্যা চোখ মুছতে মুছতে বলে, “কিন্তু... মানুষ তো এভাবে ভাবে না,” একটু দ্বিধায়,
“ আর তাছাড়া মানুষকে বেঁচে থাকতে গেলে, তো
বাঁচাটাকেই ধ্রুব বিশ্বাস করতে হবে, সেটাকেই আঁকড়ে ধরতে হবে
দৃঢ় ভাবে, না?”
“কীরকম দৃঢ়? লোহার রডের মতো?” খোসা হাসে, “আসলে,
মানুষ কথাটাই গোলমেলে, বুঝলে, মানুষ বলতে নির্দিষ্ট কিছুই বোঝা যায় না, একটা
হাল্কা শরীর-কাঠামোর ধারণা — ব্যাস। মানুষের মাথা এত জটিল,
তার প্রকার প্রকরণের ব্যাপ্তি এত বড়, যে এক
প্রান্তে দাঁড়ালে আরেক প্রান্তকে মানুষ ব’লে চিনতেই সমস্যা
হয়। ফলে কী করা? মাঝে যারা থাকে তাদের বলা হয় মানুষ। আর সব
প্রান্তের অধিবাসী হয়ে পড়ে প্রান্তিক। শুধু গরীব গুর্ব আদিবাসী এরা নয়। প্রকৃত কবি
শিল্পী বিজ্ঞানী অঙ্কবিদ এরাও... এরাও প্রান্তিক। তাই এই দুই দল, দুই দলের জীবন ও জীবিকা নিয়েই চলে মানুষের রাজনীতি। মাঝখানের মানুষ,
সব কিছুকে ‘দৃঢ়’ মর্মে
বুঝতে শেখা মানুষ, সবসময়ই প্রান্তিক মানুষকে তার প্রয়োজনে
ব্যবহার করতে চায়। করেও। কবি সেজে, বিজ্ঞানী সেজে ঘুরে বেড়ায়
ক্ষমতালোভী চাটুকার... মানুষের খিদে, সুস্থভাবে বাঁচার ইচ্ছে
হয়ে ওঠে ভোটযন্ত্রের রশদ। আর বিপ্লবীর ছেলে তার বাপের মতোই বিপ্লব করতে থাকে...
দশকের পর দশক ধ’রে। তার বিপ্লব তার প্রতিবাদও আসলে
রাষ্ট্রক্ষমতার অংশ হয়ে যায়। সে বোঝে, কিম্বা বোঝে না। সে
জানে না, প্রতি মুহূর্তের রসায়ন লাগে পৃথিবীতে... সময়ের সাথে
সাথে সেই জমা রসায়ন বদলে দেয় সংকট, তার চেহারা। ফলে সংকট না
চিনেই, শিখিয়ে দেওয়া প্রতিবাদ গেয়ে চলে সে... তাতে ক্ষমতারই
উপকার হয়।”
দূরে প্রাণের প্রপাত উড়ছে। তার ধুলো
স্তর ছড়িয়ে আকাশে, ইতিহাসের ঘাম জ’মে
আছে। রঙ নেই, অথচ রঙের বিভ্রম... ইচ্ছে নেই অথচ মনে হয়
ইচ্ছের রোঁয়া উঠছে আবহাওয়ার সুতোয়। নিশ্চিত তার ভ্রান্তিকে আশ্রয় দিয়েছে... স্থির
দিয়েছে তার চঞ্চলতাকে। চিরন্তন আছে... আবার তার অণু-পরমাণুর ভাঁজ দিয়ে বাচ্চাদের
নৌকো বানানোর কায়দাটাও আছে। এমন সমস্তের মাঝে ব’সে খোসার
কথাগুলো বড় বেমানান ঠেকছিল রাজকন্যার। বড়ই বেশি বৈষয়িক। এ’ যেন
রাগসঙ্গীতের আসরে শববাহকের হরিবোল এসে ঢুকছে। কিংবা কবিতার সভায় কোনো বেয়াদব নাক
ডাকছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাজকন্যা বলল, “থামো”।
খোসা বুঝতে পারে। স্মিত হেসে থামে, প্রসঙ্গ বদলায়, “আচ্ছা... রবীন পাখির কথা মনে আছে?”
রাজকন্যার চোখে হঠাতই যেন ঝিলিক
খেলে যায়।
পাখিটির নাম ছোট্ট রবীন
ডানায় আঁকা যাযাবর জিন...
ডানায় আঁকা যাযাবর জিন...
প্রায় স্বগতোক্তির মতো, “ওঃ রবীন!” সাথে সাথেই খোসার দিকে ফিরে রাজকন্যা বলে,
“কবে আসছে সে?”
“বোধহয় আর কোনোদিন না”।
কোনো গভীর আঘাতে সাথে সাথেই
যন্ত্রণা তৈরি হয় না, কয়েক মুহূর্ত অবাক অস্বাভাবিক
না-বুঝতে-পারা কাটে। রাজকন্যাও তেমন ভাবহীন রেখাহীন মুখে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
“শেষ তাকে দেখা গেছিল,
ফ্লোরিডা, লঙউড গার্ডেন। মনে আছে, দ্য সেনেটরের কথা?”
“সেই সাড়ে তিন হাজার বছরের
পুরনো গাছ?”
“হুম। মানে, মোটামুটি ধরো, নীলনদের ধারে মিশর সভ্যতা... পঞ্চম
ফেরাউন হাতশেপসুত, মহিলা... দ্বিতীয় মহিলা শাসক, গদিতে। সেই সময় গোলার্ধের প্রায় বিপরীতে সভ্যতার আলোর নিরিখে অন্ধকার এক
প্রদেশ, যেখানকার মানুষ কেবল মাটির জিনিস বানাতে জানে,
সদ্য শিখেছে কবর দেওয়া, খুব শিখেছে। মিশরে যখন
পিরামিড, মৃত্যুতে এসে মিশছে সূর্যরশ্মির আদল... খানাপিনা,
আতর, কত বিলাসিতা... অন্তত রাজ-মৃতদেহের
ভাগ্যে... পরবর্তী সভ্যতার বিস্ময়ের আয়োজন হচ্ছে... তখন এই অন্ধকার প্রদেশে মৃতরা
খুশি — কবর আবিষ্কার হয়েছে… পৃথিবীর
শেষ যন্ত্রণা চোখে এঁটে তারা চেয়ে থাকে ওপর থেকে পড়তে থাকা মাটির ঢেলা আর
নুড়ি-পাথরের দিকে... হয়ত দ্যাখে, হয়ত বা দ্যাখে না।
ফ্লোরিডা। সভ্যতার বিপরীত গোলার্ধে এই প্রদেশ। এখানেই সেদিন জন্ম নিচ্ছে এক চারা।
হয়ত কোনো নতুন নকশা নতুন ধরণের কবর ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অবাক মানুষদের পাশে।
আবিষ্কৃত মৃত্যুর পাশে জীবন... শুরু হচ্ছে।
(চলবে...)
|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৮ (ধারাবাহিক) ||
মন্তব্যসমূহ