রূপকল্প
|| ইন্দ্রনীল ঘোষ ||
চতুর্দিকে প্রাণ। জীব ও জড়ের
প্রাণ। দৃশ্য ও অদৃশ্যের প্রাণ। শ্রাব্য ও শ্রবণাতীত প্রাণ। এর মাঝে দাঁড়িয়ে, হঠাতই, ভয় করল রাজকন্যার। খাঁ-খাঁ প্রাণের ধুলো...
প্রাণের রেগিস্তান... ইচ্ছাহীন, অনুভূতিহীন আবেগহীনভাবে
শুধুই ছড়িয়ে পড়ছে। সময় নেই, কারণ সীমা নেই। জীবনের পরিচিত
পরিসর নেই, কারণ আর্দ্রতা নেই। বিস্তীর্ণের সমস্ত দিকও
বিস্তীর্ণ।
রাজকন্যা একবার ফিরে তাকাল প’ড়ে
থাকা ব্লেডটার দিকে, তার খোলা র্যাপার আর বাক্সের দিকে,
বাক্সের গায়ে লেখা ব্রান্ড-নেম হরফের দিকে। চাইল একটু সম্বিতে ফেরা,
একাত্মতা, এই মুহূর্তের এক পরিচিত অংশ —
যা স্থূল, ছোঁয়া যায়, চটকালে
হাতে আঁশ লেগে যায়। ব্লেডের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, নদীর
পাশে প’ড়ে থাকা পাথর আর ঠাণ্ডা রোদ। রাজকন্যা সেদিকে তাকাল।
একটু আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। সেই না করা আত্মহত্যা প’ড়ে
আছে নদীর পাশে। রাজকন্যা সেদিকে তাকাল। তার আঁচ টের পেলো না। সেই মুহূর্তের
উত্তেজনা স্তব্ধ হয়েছে। নিজেকে, নিজের ব্যক্তিগত সমস্ত
মাত্রার বুননকে সীমায় টের পেল সে। যেন বিশাল এক ভাষার সমুদ্রে, সে এক কথোপকথন শুধু, এ’ মাত্র
স্তব্ধ, নিজেরই খোসার কাছে নিজের তীর্থ খুঁজে ফিরছে।
ধু-ধু এ’ প্রাণের রেগিস্তানে, এই একমাত্র খেলার সামনে এসে
দাঁড়াল রাজকন্যা। একখানা খোসা টেনে ছিঁড়ল — নিজের থেকে...
তারপর আরেকটা... আরেকটা...
ভাবল, এ’ খেলার মুখ তবে কোনদিকে? ভিতর
নাকি বাইরের দিকে?
খোসা বলল, “উত্তর দিকে।”
“তা উত্তর দিক কোনটা শুনি?
আমার কাছে তো আর কম্পাস নেই!”
“আমার কাছে আছে বটে
একখানা। তবে তাতে কাঁটা নেই।”
“যাব্বাবা!”
খোসা একটু ভেবে বলল, “দিক যখন নেই-ই... ধরো সবটাই মিউজিক।”
রাজকন্যা ফ্যালফ্যালে চোখে তাকায়, “তবে ভিতর আর বাইরে ব’লে কিছুই নেই?”
“নেই তো! সবটাই শুধুমাত্র
এক মিউজিক।”
রাজকন্যা উদাসভাবে মুখ ঘোরালো।
দূরে প্রাণের প্রপাত উড়ছে, সেদিকে চোখ রেখে তার মনে পড়ল অনেক আগের
টাটানগর... প্রতি সন্ধেয় পাহাড়ের চূড়ায় ইস্পাত কোম্পানির ঢেলে দেওয়া বিস্তীর্ণ
স্ল্যাগ... আর তার উড়ন্ত আগুন... পাহাড়ের গা দিয়ে... আর সিংভূম কুমার... পাহাড়ের
চূড়ায় গুপ্ত যে ঘোড়সওয়ার... অপেক্ষায়... অন্ধকার নিপুণ হলে যে নেমে আসে, আত্মহত্যার উপকথায় ছায়া পড়ে যার।
সেই স্ল্যাগ দেখা চোখেই তাকিয়ে
থাকে রাজকন্যা। প্রাণের প্রপাত উড়ছে। এক প্রাণের সাথে অগুনতি আরো কত না-জানি
প্রাণের ধাক্কা লাগছে... তৈরি হচ্ছে রঙের বিভ্রম। এতক্ষণে লক্ষ্য করল রাজকন্যা এক
বিভ্রমের দূরত্ব থেকে গোটা বিস্তৃতিই রঙিন মনে হয়... ইচ্ছা, আবেগ, অনুভূতির রোঁয়া ওঠা।
“ছোটবেলায়”, ধীর গলায় বলে রাজকন্যা, “ছোটবেলায় যখন ছবি আঁকতাম...
প্যাস্টেল... প্রচুর আকাশ থাকত ছবিগুলোয়... তো কী হতো... ওরকম দু’তিনটে ছবির আকাশ রঙ করার পরেই নীল প্যাস্টেলগুলো যেত ফুরিয়ে। আর আমি জানলা
দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবতাম, সত্যিকার ওই অতো বড় আকাশ রঙ করার
পর তবে আর কোনো নীলেই রঙ বেঁচে নেই? সব শেষ? সত্যিকার এই যে এত ঘাস মাঠ... এরপর রঙ বাক্স খুললে আর কোনো সবুজ পাওয়া
যাবে না?”
খোসা বলল, “ভয় হতো না?”
“হুম হতো। খুব হতো। সব রঙ
হারিয়ে গেলে আমি ছবি আঁকব কীভাবে? কীভাবেই বা ব্রতকথা করব?
পুণ্যিপুকুর? আমার দুঃখ হবে, আত্মহত্যা হবে? ব্লেডে লেগে থাকা শুকনো রক্তের
গুঁড়োর মতো নেমে আসবে হেমন্তকাল? একটা চিরকালীন নিঃশ্বাস
খচখচ করবে আবহাওয়ায়?”
“তুমি বড় কাব্যি করো
রাজকন্যে”, খোসা বলল, “অবিশ্যি তা
তোমায় মানায়...
সিংহাসনে ব’সে
একটা দেশ চালানোর দুঃখ
ওই দুঃখটাই রাজা
যার সব প্রজাই আইসক্রিম...
ওই দুঃখটাই রাজা
যার সব প্রজাই আইসক্রিম...
তো তোমরা হলে গিয়ে সেই আজব মানুষ।
কাব্যি না হলে তোমাদের কেমন জ্যান্ত ব’লেই মনে হয় না।”
“ও, তুমিও
আমায় নিয়ে মজা করো বুঝি?” রাজকন্যা অভিমানে মুখ ঘোরায়। উঁকি
মেরে খোসা দ্যাখে - তার চোখে জল।
“আহা... চটছ কেন? আমি তো সেভাবে কিছু বলিনি...”, এই ব’লে রাজকন্যার মাথায় হাত বোলাতে যায় সে।
(ক্রমশ...)
|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৮ (ধারাবাহিক) ||
মন্তব্যসমূহ