“আমার কিছু হয়নি মারানিরা”


|| শুভদীপ চক্রবর্ত্তী ||

১.

হ্যাঁ হ্যাঁ লিখছি লিখছি লিখছি উফফ তো চাট তো শেষ তাই কী আর, খড়ি ওঠা দেওয়াল থেকে চুন চেটে নিচ্ছি মাঝে মাঝে। হ্যাঁ হ্যাঁ, হ্যালো হ্যালো, শোনো ওই সব কাশ ফুল টুল ভালোলাগে না আমার আর। শরৎ-বসন্ত কিছুই তো বোঝা যায়না সেভাবে আর, আর ... সেবন্তীটাও চলে গেলো। গদিতে বসে কাপড় ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিলে আমি পছন্দ করতে পারিনি কোনোদিন সেভাবে,অথচ সস্তার ঝুলে থাকা রঙীন থেকে হাত বাড়িয়ে বেছে নিয়েছি কত সহজে। সহজ তো বোঝেনি ওরা; আমি যা সব লিখতে চেয়েছিলাম ... এই এক বাড়ি, একলা ঘর ... ধুত্তোর ... খন্ডহর খন্ডহর ... ওসব চোখের পাতা-টাতা কে ছুঁতে চায়; তার চেয়ে বরং, ওহহ্, হ্যালো হ্যালো, এত চুপ কেন? এত নিস্তব্ধতা পোষায় না এখন আমার। তোকে ভালোবাসতাম খুব, তুই তো জানতিস রীতা। জানতিস তো যে কী ভীষণ ভালোবাসতে পারি আমি! তবু, সেবন্তী ছেড়ে গেল কেন বলতো আমাকে? জীবন কী আর শেয়ার নাকি? তেজী বাজার, গড়পড়তা, চলবে না বা কম দামী?



অবশ্য তুইই বা কী করে জানবি। বজ্রে বজ্রে বাঁশি বাজলে সেকি সহজ গান থাকে! অথচ সত্যি যেটা, সেটা তো সত্যিই! সেবন্তী বলতো ঢেউতে না ভেসে ঢেউয়ে পা ডুবিয়ে বসে থাকাও একটা জীবন। অথচ তুই কী অবলীলায় বলেছিলি, “তোর সাথে ঝর্ণায় ভিজবো একদিন হ্যাঁ” ... আট বছরের ছোট তুই আমার থেকে অথচ বেমালুম তুই-তোকারি! জানিস এখন টেক্সাস থেকে সেবন্তীর মেল এলে আমি স্বপ্ন পাই; কিন্তু রিপ্লাই দিইনা। মনে হয় যে একটা পাঁচিল তুলে দিতে পারেনা সাদা গুলো ওদের দেশের চারপাশ দিয়ে? ইচ্ছা করেনা ওকে বলি, এবার শীত আসছে তাড়াতাড়ি, সেই সেবারের মতন! সকালের ঘরটায় রোদ এসে পড়তো জানালা দিয়ে, আর সেবন্তী চাদরটাকে আরও একটু টেনে নিলে গায়ে জানালার পর্দাও গান হয়ে যেত কেমন, “নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে নীল যমুনায় কে যায় কে যায়...” সেবন্তীতে ভাসতে যাবো যে সময়, সে সময়ই কেমন মেসেজ আসতো তোর। কপালে হলুদ দেখতে পেতাম; কোমরে পেঁচানো আঁচল। “...হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে।” আর আমার হারানো হতো না কোথাও। শুধু গর্ত আর গর্ত আর গর্তে লুকানো সরীসৃপদের হিলহিলে চেরা জিভের আঁচড় থেকে বাঁচতে শুধু দৌড় আর দৌড় আর সেবন্তী কী বলছিল মুখ ফিরিয়ে শোনাই হলোনা আমার তারপর শুধু হঠাৎ ভীষণ ঘুম আর কখন কী জানি ঘুমের থেকে আলো সরাতে সরাতে বুঝলাম নোনা বালি আমার মুখে চোখে। “...ইয়ে এক টুটা হুয়া তারা...” কেউ একটা পিয়ানো বাজাচ্ছে আর রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে খুব। “বাইসারো বীরা মাহনে... পিহারিআলে চালু সা... পিহারি আরি মাহনে অলু আওয়ে... গোকুলা মাঝে, আজিহে গোকুলা মাঝে, মধুর মুরলী বাজায়...”  আর শুধু ফ্ল্যাশবাল্ব, আর শুধু আলো, আর কত কত ছবি। ছিন্ন পাতায় কে সাজিয়েছিল তরণী বলতো, কাদম্বরী দেবী?



২.

আর যতই ঘুম আসেনা সারারাত, ততই যেন ভুলভাল হয়ে যায় কেমন। আরে ধুর ধুর, ট্রেন যাচ্ছে বলে বাসটা দাঁড়িয়ে আছে কতক্ষণ, আর পুকুরের ওই পাড়ের বাড়িটায় পৌঁছাতে দেরী হয়ে যাচ্ছে শুধু। “রঙ্গে শাড়ি গুলাবী চুনারিয়া রে...”  জানালার পর্দা থেকে রঙ নামছে ছাদ থেকে গড়িয়ে। দিগন্তের ওপাড় থেকে নৌকা নিয়ে আসবে নোয়া আর তাতে অ্যাডাম-ইভের মতন উঠে পড়বো আমরা দু’জন, এই ভেবে কতদিন দাঁড়াতে চেয়েছি সারাদিন সমুদ্রের ধারে অথচ এপাড়-ওপাড় দেখা যায়না বলে সেবন্তী সমুদ্র পছন্দ করেনি কখনো। পুকুরের টলটলে শান্ত কালচে সবুজ জলের দিকে তাকিয়ে থাকতো অনেকক্ষন আর আঙুল বাড়িয়ে আমার আঙুল খুঁজতে চাইলেই মেসেজ টাইপ বন্ধ হয়ে যেত আমার। “বাজে ঢোল বাজে খোল, হোলিরও উঠিসে রোল...” কিন্তু চেরাই হয়ে গেলে, কাঠের কোন ভাগ করাতের থাকে, তা নিয়ে হোক না কলরব হোক! যা খুশি হোক! আমি শুধু পাউডার চাই একটু ... একটা রিফার ... উফফ, কতদিন তোকে দেখিনি ... কতদিন দেখিনি তোমাদের ... একটু শালুক একটু শিউলি ... আমি শুধু ঢেউয়ের গন্ধ চুলে নিয়ে ঘুমিয়ে থাকবো অনেকক্ষন ... আমি শুধু বেরোতে চাই এই ঘরটা থেকে, যেটাকে তোমরা সাজিয়ে গুছিয়ে যাই বলো, এটা যে আসলে গারদ আমি জানি। আমার কিছু হয়নি মারানিরা। আমার জন্য শুধু একটা বিছানা পেতে দিয়ো এই পৃথিবীর তিন ভাগ জলের পাশের কোনও এক বিন্দু স্থলে। ঢেউ ছুঁয়ে যায় এমন একটা আকাশ ভরা তারাদের নিচে বিছানা পেতে দিয়ো। কিচ্ছু চাইনা আমার আর, শুধু রাত বাড়লে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ো, সেবন্তী অবন্তী টাপুর বা বীণা মাসি, যে কেউ ... আমি তোমাদের চোখের থেকে তারা পাড়বো, স্নান করবো, গুছিয়ে রাখবো ধুয়ে-মুছে একটা-দু’টো, গুনে গুনে ... আমার রেডিওটা খুঁজে পাচ্ছিনা ... গানটা যে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে কে জানে?


“তোমার সাপেরও বেণী দোলেনা, দোলেনা হাওয়ার বাঁশী শুনে....”


|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৭ ||



মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা