নাইন্টি নাইন পয়েন্ট নয় নয় নয় নয়
|| সুপ্রিয় মিত্র ||
নকল হইতে সাবধান! তালমিছরির বিজ্ঞাপনের দিকে ও তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ- বিশেষ 'R' মার্ক দেখে কিনুন।
কী দরকার 'আর' মার্কের?
যদি তালমিছরির নাম রালমিছরি হয়ে যায়, আর প্রথম অক্ষর বড় 'আর' লেখা হয়, তাহলে খরচ কিছু কমতে পারে… ও এইসব ভাবছিল। শুধু একটা 'আর'-এর ছাপ্পা জগতের সমস্ত নকল তালমিছরি থেকে আসল তালমিছরিকে আলাদা করে রেখেছে! 'আর'-এর তো অসামান্য শক্তি… জিওহ জিওহ। ও কিছুতেই ভাবনাকে থামাতে পারছিল না। বাহবায় বাহবায় তা আরও এগিয়ে যাচ্ছিল, যতটা না-এগনোর কথা।
রাস্তায় এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে সাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গিয়ে সাইকেলচালক বিরক্তমুখে 'আরে' বলতেই ও বুঝতে পারল আরেকটুর জন্য 'এ' বাদ গেলে এই ধাক্কা নকল থাকত না। নকল ধাক্কা পেরিয়ে আসল রাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে রামায়ণের রাম আর রাবণকে মনে পড়ল। কে যে আসল বোঝা গেল না। কিংবা দুজনেই আসল। দুজন আসল একে অপরকে মুছে দিতে চাইছে সীতার জন্য। একটা 'এস'-এর জন্য। যেমন ওর বন্ধু 'এস'-কে বন্ধুর প্রথম প্রেমিকা 'আর' মুছে দিতে চেয়েছিল। পেরেছিল। কিন্তু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি। মুছতে মুছতে রোঁয়া তুলে দিয়েছিল পাতার। রূপম ইসলাম মাথা ঝাঁকিয়ে হাত মুঠো করে পায়ের চেটোর ওপর দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বিচি শক্ত করে স্পীকার থেকে গাইছিলেন তখন- কেন করলে ‘Aরকম’? ও গানটা থামিয়ে বন্ধুকে বলেছিল- এ কী রে, এ তোর কী হল? একটা প্রেমই তো। জীবন তো নয়।
ও-র একটা দাবড়ানিতেই বন্ধু উঠে দাঁড়িয়েছিল। এই উঠে দাঁড়ানোর স্মৃতি ও-কে আদিগন্ত অহংকার দেয়। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার অহংকার। মজার কথা, এই অহংকারই তাকে পুরোপুরি বিলিয়ে দেওয়া থেকে বিরত রাখে। খুবই জটিল, কর্কশ অথচ গুরুত্বপূর্ণ।
ও অন্যমনে এইসব ভাবতে ভাবতে 'B' নামের একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল। তার ভাড়াবাড়ি। পাশাপাশি সমস্ত বাড়ির নাম 'আর' দিয়ে শুরু। সেখানে কেউ ভাড়া থাকে না। যে যার নিজস্ব বাড়ি। শুধুমাত্র, এই বাড়ি ভাড়াটেদের জন্য বরাদ্দ। ভাড়াটের 'বি'। বি নাম। বেনাম। কিন্তু, 'বি'-এর তলার দাগটা হালকা মুছে গিয়ে আবছা 'আর' হয়ে আছে। ও জানে, দাগ স্পষ্ট হয়ে গেলে সত্যি সত্যি 'আর' হয়ে যাবে। বাড়ি আর ভাড়াটের থাকবে না। আসল আর নকলের মাঝে ঝুলে থাকা এই 'আর' আর 'বি' নিয়ে ক্লান্ত ও ঢুকে পড়ল ঘরে। লোককে ও বলতে শুনেছে- আর মাথায় কিস্যু নেই দাদা, আর পারছি না, আর না প্লিজ, আর পারা যায় না।
ওরও আজ এই প্রথম মনে হচ্ছে- আর মাথায় কিছু নেই ভাববার মতো। আর পারছে না। আর না প্লিজ। আর পারা যায় না।
‘আর জানি না।’
বাবাকে এটাই উত্তর দিয়েছিল ও। যখন বাবা জিজ্ঞেস করেছিল- ক্লাসে আর কতজন নকল করেছে। ও কখনও নকল করেনি। না না করেছে, নকল হাজমোলার প্যাকেট। কিন্তু কোথা থেকে এই নকল হাজমোলা তুলেছিল, তা মনে করতে গিয়ে আসল জায়গা গুলিয়ে গিয়ে নকলের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক না। বাবা বলেছিল- কখনও নকল করবে না, নকল করার কথাও ভাববে না।
কিন্তু বাবার এই কথা পুরোপুরি আসল নয়। কারণ, বাবা এইভাবে তুমি করে কথা বলে না। কথাকে ভার দিতে গেলে, বাবা তুমি সম্বোধনে কথা বলে।
‘আসল বলে কিছু হয় না। পৃথিবীর শুদ্ধতম পদার্থও নাইন্টি নাইন পয়েন্ট নাইন নাইন নাইন নাইন পার্সেন্ট অবধি আসল, বাকিটা আগামীর জন্য তুলে রাখা কৌতূহল।’
ক্লাসে এরকমটাই বলেছিল ওর বাবা।
ও একদিন ক্লাসে অন্য স্যরের গলা নকল করেছিল। পাশের ক্লাস থেকে বাবা শুনতে পেয়ে গেছিল। যদিও বাবা শুনতে পায়নি। স্যর শুনতে পেয়েছিল। বাবা বলে দিয়েছিল, স্কুলে কখনও বাবা বলে ডাকবে না। স্যর বলবে। টিফিনে খিদে পেলেও আসবে না পয়সা চাইতে।
তা, স্যর এসে ‘আর করবি?’ বলে উদোম চাবকেছিল পিঠে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে স্যররাই স্যরদের নকল করে দেখানোর বায়না করেছিলেন। অনুষ্ঠানের আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছিল ও। স্যরদের আদেশেই। স্যর যখন চাইবেন তখন মজা, তখন নকল। নয় তো, নয়। নাইন তো নাইন। ‘পুরোটা আসল কখনও হবে না, বাকিটা আগামীর কৌতূহল।’ এইটা শেষে বলে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছিল ও। পিঠে ছড়ির দাগ ভিতর ভিতর জেগে উঠছিল ওর। ও আর দাঁড়াতে পারছিল না।
কিন্তু, ও জানে, বাবা-মায়ের ঠোঁট নড়াচড়া আর শব্দ নকল করেই ও ভাষা শিখেছে, বলতে শিখেছে। এমনকী, বাবার রক্তের গ্রুপ আর ওর রক্তের গ্রুপ এক। ও পজিটিভ। কিন্তু ওর রক্ত তো ‘R’ for রক্ত নয়, B for ব্লাড। ও-র নিজের রক্তকেও ভাড়া করা রক্ত মনে হয়। ‘বি’-এর তলাটা আবছা। অণুচক্রিকা, শ্বেতকণিকা যেন ব্ল্যাকবোর্ডে চকের শ্বেতগুঁড়োর মতো আবছা পড়ে আছে সেখানে। ওর বাবা স্যর বা ওর স্যর বাবা সেই বোর্ড একদিন মুছে ফেলতেই পারেন, এরকম ভয় ওর হয়েছিল অনেকবার। ও কিছুতেই পজিটিভ থাকতে পারে না। থাকার চেষ্টা করে যায়।
ও আজকাল গাছ আর পাথরকে নকল করে। পাথর, যখন ঘুমোয়। একটুও নড়ে না, চড়ে না। যেমনভাবে ঘুমোয়, সেইভাবে ঘুম থেকে ওঠে। গাছ, যখন নিজেকে নিজের ছায়া হতে হয়। বড় বড় চুল রেখে ও নিজের চোখের আশপাশ, কপালের ভাঁজ লুকিয়ে রাখে। চুলের ছায়ায় ওর অন্ধকার আবছা মুখ ওর কোনও নকল হয়ে ওঠে। ও এভাবে থাকতে পছন্দ করে। কারণ ওর বাবা স্যর বা স্যর বাবা বলেছিল ক্লাসে, আসল বলে কিছু হয় না।
ও আজ চব্বিশ ঘন্টার মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট ওকে নকল করেছিল। বাকিটা সময় বিভিন্নজনকে নকল করে কাটিয়েছে। ‘এইচ'কে নকল করে বলেছে ‘হ্যাঁ’, ‘এন'কে বলেছে ‘না’। ও গাছকে নকল করতে গিয়ে ওর মনে হয়েছে, সম্ভবত গাছ কোনও ভিড়ে আটকে আছে, তাই এগোতে পারছে না। তাই শামুককে নকল করে একটু এগোতে গিয়ে দেখল, ওর কোনও ঢাল নেই, খোলস নেই যে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে। বাঁ পায়ের কড়ে আঙুলটা ঘ্যাঁক করে থেঁতলে গেল, সেই থেকে সাড় নেই। ও বিরক্ত হয়ে আর কাউকে নকল করবে না ঠিক করে হাওয়াকে দেখার চেষ্টা করল।
হাওয়া। চারদিকে তখন হাওয়া আর হাওয়া। এ গলির হাওয়া অন্যগলির হাওয়াকে নকল করে ছুটে যাচ্ছে আর মানুষের চুল ঘেঁটে দিচ্ছে। মানুষ তখন নিজের হাতের আঙুলকে চিরুনিকে নকল করে, তার আগের চুলের স্টাইলের স্মৃতিকে নকল করে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। করে চলেছে। পারছে না। হাওয়া শুধু এই করেই থামছে না। মানুষের নাসারন্ধ্রের সাইজ নকল করে ঢুকে পড়ছে ভিতরে আর খোলনলচে জেনে বেরিয়ে আসছে এদিক-ওদিক থেকে। ভিতরের হাওয়ায়, আগের নিশ্বাসকে নকল করে মানুষ তাকে ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচে। হাওয়াকে আর নিজে থেকে নকল করতে হচ্ছে না। ও ভাবল, হাওয়াকে নকল করার চেয়ে আর ভালো কিছু তো নেই।
তাই, আজ থেকে শুধু হাওয়াকে নকল করবে বলে যাকে যাকে সামনে পেল, আর যাকে যাকে মনে পড়ল, নকল করে নিল। এক মিনিট অরণ্যকে নকল করে পাহাড়ের চাদর হয়ে গেছল আর প্রিয় মানুষের বৃহৎ বা বৃহত্তর দুঃখের আড়ালকে সে জড়িয়ে ধরেছিল। পাঁচ মিনিট এস্কেলেটরকে নকল করে একই জায়গায় ঘুরপাক খেতে খেতে রাস্তার অচেনা লোকদের দিক বাতলে দিয়েছিল ও। নয় মিনিট ও, ওর দাদাকে নকল করে দাদার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝাতে চেয়েছিল, দাদার মতো বড় হতে ও পারবে না। আঠেরো মিনিট ও নিজের ভাবতে বসার ভঙ্গিমাকে নকল করে অন্যের ভাবনায় সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ার প্যাঁচ বোঝার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দেখল প্রত্যেকেরই ভাবনার গায়ে একটা খোলস বা ঢাল আছে। ওর ভাবনা হুড়মুড়িয়ে ধাক্কা খেয়েছিল মাথায়। মাথা ফেটে সেই এক কাণ্ড। হু হু করে ও দেখল, ও পজিটিভ বেরিয়ে যাচ্ছে। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে অসংখ্য পজিটিভ গুণ চিহ্ন হয়ে জমাট বেঁধে থমকে যাচ্ছে রাস্তায়। রাস্তার পাশে গাছকে তারা নকল করছে ও বুঝতে পারল।
ধাক্কা যতটা ওর লেগেছিল, ততটা খোলসেরও তো লেগেছিল। খোলস থেকে মুখ বাড়িয়ে অন্যান্য সব ভাবনা চোখ তুলে দেখল, ও পড়ে রয়েছে কেমন চোখমুখ ঠিকরে। অচেনা অনেকে জিগ্যেস করল, ও কে? চেনা অনেকে বলল- ও ও।
ও ভাবল, তাকে কেউ দু'বার নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু ও উঠতে পারল না। কিছুতেই পারল না। ওর মাথা থেকে হাওয়াকে নকল করে এ জীবনটা চালিয়ে দেওয়ার কথা হাওয়া হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল ও-কে। ডাক্তার বলল- সব ওকে। আর কোনও চিন্তা নেই। ওষুধ শেষ হলেই যেন আবার আসে।
ও ডাক্তারের কাছে বারবার যাবে বলে ওষুধকে মেরে ফেরে খুন করে যেমন করে হোক শুধু না খেয়ে শেষ করে ফেলল অনেক অনেকবার। কিছুদিন ভিজিটের পরেই ও ডাক্তারকে নকল করে ফেলল আর আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবদের ডাক্তার হয়ে উঠল ও। ও সবার খেয়াল রাখার নকল করে ভাবল এভাবে কাটিয়ে দেওয়াও তো মন্দ নয়। ও এমনকী ডাক্তারের ‘D’ দেখে কষ্ট পেল কেন এর মাঝবরাবর ‘B’-এর মতো দাগ নেই। তাহলে তো তলার দাগটা স্বচ্ছ হলেই ডাক্তার ‘R’ হয়ে উঠবেন, ডাক্তারের কোনও চিন্তা থাকবে না। ডাক্তারের খেয়াল রাখে কে? ডাক্তার কার পেশেন্ট। পেশেন্টের ‘P’ দেখে ও কুঁকড়ে গেল কষ্টে। আর একটা দাগ যদি ‘পি'-এর চিবুক ধরে ঝুলে যেতে পারে, তাহলেই ‘R’ হয়ে ওঠা। দু’জনেই তখন আসল। দু’জন আসল দু’জনকে খেয়েখুয়ে কেটেকুটে এই নকল দুঃখকে নকল করে ফেলা আনন্দের পৃথিবী থেকে নির্বাণ নিয়ে চলে যেতে পারে।
নিজের সমস্তটা দিয়ে দেবে যদি প্রয়োজন হয় এই ভেবে ও, পি-কে জিগ্যেস করল- তোমায় একটা দাগ দিলে তুমি তো ‘আর’ হয়ে উঠতে পারো।
পি তার পিঠের ব্যাগ খুলে দেখালো এই এক লম্বা শক্ত কালশিটে। তাকে ছাতার মতো খানিক দেখতে। খাঁজকাটা। খানিক শিরদাঁড়ার মতোও। পি ব্যাগের চেন ফের লাগাতে লাগাতে বলল, অপারেশনের আগে আমি তোমায় নকল করে ও হয়ে ছিলাম।
ও আর এক মুহূর্ত না-ভেবে বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় এদিক ওদিক টাল খেতে খেতে গড়িয়ে যেতে যেতে ভাবল, হাওয়াকে নকল করে এ-জীবন কেটে যাওয়ার চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।
হাওয়াকে নকল করে ও এগিয়ে গেল হাওয়ার দিকে।
ও-কে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। হাওয়া হয়ে যাওয়ার আগে ও লোককে বলতে শুনেছিল- আর বল, কোথায় হাওয়া হয়ে গেছিলিস?
ওরও আজ বলার ইচ্ছে হচ্ছিল- আর বল, কোথায় ও।
কিন্তু ততক্ষণে ও হাওয়া। মানুষের প্রশ্বাসে প্রশ্বাসে সে পুরোদস্তুর ঢুকে ঢুকে ঘাপটি মেরে শেষ নিশ্বাস হওয়ার অপেক্ষায় প্রত্যেকটা নিশ্বাসকে ও নকল করে চলেছে, একদিন বেরিয়ে পড়বে।
|| আঙ্গিকে কবির গদ্য ৬ ||
মন্তব্যসমূহ