তন্ময় ভট্টাচার্য



চলে গেলে যেরকম


(১)
মাঝখান থেকে শূন্য এই ঘর এই কারাবাস
জানলায় চোখ যায় - তার ডাক এল কি এল না

আসবে না কখনও তা জেনে গেছি বলেই আমার
এ-শীত দয়ালু লাগে, হিম করে দিয়েছে পাঁজর

পাঁজরের ফাঁক দিয়ে ভাবি মুখ চেয়ে আছে, তাই
এখনও আপনমনে তার জন্য বিছানা সাজাই

(২)
সেও কি বুঝেছে, বলো, সেও কি বুঝেছে একদিন
এভাবে পালাবে তাই যত বেশি স্মৃতি হওয়া যায়
সেই চেষ্টা ছিল তার? তাই দুঃখে এতটা অনাথ?

আমি তার পাশে বসি
মৃতগন্ধ নিই, আর
আসলে পারিনি তাও শরীরে স্থাপন করি হাত

(৩)
বাবাকে প্রশ্ন করি
থমকেছে খানিক বাবাও

ভেবেছি, বলবে সব সেরে গেছে - স্বাভাবিক
নিজে থেকে উঠে বসে ছড়িয়ে দিয়েছে বেশ পা'

বলবে খেয়েছে কিছু, দৌড়ঝাঁপ, আগের মতই
বলল যা, মরে গেছে আমার সবচে' প্রিয় বই

(৪)
বইয়ের থেকেও স্পষ্ট ছিল তার চোখ ও আওয়াজ
আমাকে পড়তে দিলে ভুলে যেত শীতকাল
             নাওয়া-খাওয়া নেই সারাদিন

আমি তাকে কোলে নিয়ে ভাবতাম মেঘেরও কারণ

ঝড়বৃষ্টি হল আজ। কেউ বুঝতে পারল না।
তারপর ধুয়ে গেল, যেভাবে ক'দিন আগে বোন...

(৫)
বোনটা হিংস্র ছিল। কাছে আসতে চাইত না।
দূর থেকে ডাকত ও ছুঁয়ে দিলে ভাবত, পালাই...

আসলেই চলে গেল
রেখে গেল ভাইকে আদর

সেই চিহ্ন বেয়ে বেয়ে, আজ ভাই চলে যাচ্ছে
মানুষ পারেনি ধরে রাখতে একলা থাকা ওর

(৬)
শুকিয়ে যাচ্ছিল সে। তিলে তিলে। চোখের ওপর।
এমনই বেসেছি ভালো, ঢুকতে দিইনি তাও রোজ

ভেবেছি কঠিন প্রাণ, মরে যাওয়া এত কি সহজ

যখন প্রমাণ দিল, হা-খোলা দরজাটিকে
সামান্য ছুঁয়ে শুধু করেছি ভিতরঘরে খোঁজ

(৭)
যেখানে যাচ্ছি, শুধু তার গন্ধ... তার গন্ধ... তার...
সারা বাড়ি চেপে ধরছে, গিলে নিতে চাইছে আমায়

স্মৃতিকে বলছি - বেশ, পিষে মারো এভাবে জগৎ

অধীর চামচটিকে বলে দাও
খাওয়ার সে নেই

চাদরকে বলো, ভাঁজ
হতে আর হবে না কোথাও

আমাকে, হে স্মৃতি, তার মহৎ অত্যাচারে নাও!

(৮)
রোদেই লুটিয়ে ছিল। মা গিয়ে দেখেছে
গায়ে পিঁপড়ের ঘোরাঘুরি, দু'চারটে পাখিও দূরের

না-স্পর্শ করা জল, না-হওয়া আদরখানি তার

বাড়ি ফিরে শুনেছি, বিদায়...

শুনেছি এবং শুধু শুনেই গুঁড়িয়ে গেছি
ক্ষমা কি চাওয়ার ছিল ডাকত যে নিরীহ থাবায়

(৯)
কেন থামলে বাবা
কেন মুখের ওপরে বলে দিলে না, সে আর বেঁচে নেই

ও-ক'টি পলক আমি সত্যি ভেবেছি বলীয়ান

আবার টেবিলে উঠে কেড়ে নেবে আমার সময়
গুছিয়ে পাড়াতে হবে ঘুম আর আমিও পাশেই

মাঝেমধ্যে গান হবে; কথাবার্তা, বাঙাল ভাষায়...

কেন ভাবছি এত? যদি সত্যি গিয়েও থাকে
আমাকে চাইত না সে; চাইলে এভাবে যেতে চায়?

(১০)
সে এখন পড়ে আছে আস্তাকুঁড়েয়
আর শীত লাগছে না তার

দুর্বল গলা থেকে আওয়াজ ফুটিয়ে
বলছে না কোলে তুলে নাও

কত হিম জমে যাচ্ছে শরীরে মাথায়
যদি মরে যাওয়া ছিল ভুল?

যদি সে বেঁচেই থাকে? আমরাই জোর করে...
সোনাবন্ধু, একবার তোলো না আঙুল!

(১১)
শেষবার, কাল রাতে...
প্রথম কবে যে, মনে নেই

দেখেছি এবং সেই দেখা থেকে শুরু করে
আজ রাত্রি অবধি সে অবহেলা, চিন্তা, আদর

সেসব বালাই শেষ। অবশিষ্ট কিছু ব্যবহার।

সময় লাগবে, তবে ভুলে যাব। একদিন
এ-দিনপঞ্জি ছাড়া কোনও চিহ্ন থাকবে না তার

(১২)
এই তো, আঁচড়দাগ! হাতে-পায়ে, হয়তো মনেও

আস্তাকুঁড় থেকে হাওয়া ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার দু'চোখ

ভরে উঠছে, নেমে যাচ্ছে
জোয়ার-ভাটার খেলা

আলতো কামড় দিত
না-তাকিয়ে রেহাই কোথায়

একেই রেহাই বলে! চাই না চাই না আমি
আঁচড়ে-কামড়ে যেন আমাকে মাছের মতো খায়

(১৩)
কোলে তুলে গায়ত্রীজপ
সেও তো ঘটেছে একদিন

বিশ্বাসে পৃথিবী মিলায়
আমি কি এটুকু পারব না

ভালো হোক ভালো হোক তার
আমিগর্ব এতই সজীব

না-ফিরে উপায় নেই কোনও
ভেবেছি আমিও একদিন

সেই ভাবনা থেকে ছিঁড়ে আজ
লিখে রাখছি দু'চোখে তাহার

তুহুঁ মম অহংসমান
তোমাকে মরণ উপহার

(১৪)
আরও যে সকাল হবে
আরও সন্ধ্যা, আরও রাত্রি, ভোর

ছাদের যেখানে তাকে মৃত পাওয়া গিয়েছিল
আরও যে ধুলোর পরে ধুলো জমে বোবা একদিন

শাড়ি থেকে জল ঝরবে
গাছ থেকে, মাঠ থেকে, জল...

তার তেষ্টা পেত খুব। আর কিছু খেত না সে।
এমনকি, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তেছিল জল

(১৫)
আমাকে লিখতে দিত না সে।
কোলের ওপরে বসে আবদার আবদার
বিরক্ত হয়ে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি কতবার

কোত্থেকে কীভাবে যে চলেও এসেছে তারপর

এখনও লিখছি। আর আসবে না জানি, তাই
লিখছি। তাকে নিয়েই। শেষ খুঁজে পাচ্ছি না
                      মুখে নিয়ে পালাল এমন...


আমার এ-হাত তার পৃষ্ঠা ছোঁবে না বুঝি আর?

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা