প্রিয়ক মিত্র

বিগ ব্রাদার আপনাকে দেখছে  -একটি প্রাচীন প্রবাদ


আমেরিকা আপনাকে দেখছে। আপনি না চাইতেই। এমনকি আপনার শোবার ঘরও। নার্কোস টিভিসিরিজের প্রথমেই সে কথা বলা আছে। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ। স্বাধীন হওয়া এখন সহজ। এই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিপ্লব ঘটে চলেছে। এক প্যালেস্তিনীয় কিশোরী আহেদ তামিনি ইজরায়েলের কীর্তিকলাপ ফাঁস করছে এই সোশাল মিডিয়ার সাহায্যে। একটি ছোট্ট চারচৌকো যন্ত্রের মধ্যেই রয়েছে রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার হাতিয়ার। আবার এই সোশাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়েই এলিয়ট হিগিনস নামক এক স্বতন্ত্র সাংবাদিক বেলিংক্যাট নামক একটি সংস্থা চালাচ্ছেন, যারা জিওলোকেশন নামক একটি পদ্ধতিতে আইসিসের গোপন কুঠুরির সন্ধান পেয়ে গেছে। এই জিওলোকেশন এমনই একটি অসামান্য বিষয়, আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, কোনো বিশেষ মুহুর্তে আপনি বিছানায় থাকুন অথবা কমোডে, আপনার গতিবিধি যে কেউ জেনে ফেলতে পারে। কী অভাবনীয় বৈপ্লবিক ঘটনা বলুন, স্বাধীনতা বলতে এটাকেই বোঝায়- তাই তো?

দাঁড়ান, একটু দম নিন। একটু ধাতস্থ হোন। আপনি ভারতবর্ষের নাগরিক। বাহাত্তর বছর হল আপনি স্বাধীন। এখন, এই সোশাল মিডিয়ার যুগে আপনার স্বাধীনতা খন্ডাবে কে? কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, আপনি আর আইসিস দুজনেই নজরদারিতে আছেন, এই সোশাল মিডিয়ারই দৌলতে। ধন্যবাদ দেবেন না সোশাল মিডিয়াকে আপনার স্বাধীনতার জন্য? আপনি চাইলে আপনার পড়শির ওপর নজর রাখতে পারেন, আবার আপনার পড়শি চাইলে আপনার ওপর। আপনি , আপনার পড়শি- রাষ্ট্রের ছোট ছোট ইউনিট। বেন্থাম যাকে প্যানপটিকন বলেছিলেন, ফুকোর বিখ্যাত বই 'ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দ্য বার্থ অফ দ্য প্রিজন'-এ কল্পিত দৈত্য যে দূরবীনে চোখ রেখে নজর রাখছে সকলের ওপর; সেই দৈত্য আদতে আপনি, সেই দূরবীন আপনার হাতের মুঠোয়, আপনার নতুন হাতিয়ার।

রবীন্দ্রনাথের যক্ষপুরীতে রাজার অন্তর সকলের চোখের আড়ালেই জেহাদি হয়ে ওঠে, সর্দারের নজর এড়িয়েই। কিন্তু এখন অন্তরের খবরও বোধহয় ফেসবুক জানে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ন্ত্রণ করবে সবকিছু। ফেসবুক যে আপনার সমস্ত তথ্য মাল্টিন্যাশনালের হাতে তুলে দিচ্ছে, এতে আপনার ভয় করছে? ভয় করবে না। 'উইঙ্কল টুইঙ্কল' নাটকে উনিশশো ছিয়াত্তরের ছাব্বিশ বছর পর ঘুম ভেঙে ওঠা সব্যসাচী সেন যখন জোরগলায় দাবি করেন এটা জরুরি অবস্থা, তখন তার ছেলে সে দাবি নস্যাৎ করে জানায় এটা শীতল অবস্থা। শীতল হয়ে উঠেছেন আপনিও। তথ্য আপনাকে ঘুম পাড়ায়, তথ্য আপনার ঘুম ভাঙায়। এই বিপুল তথ্যের সাম্রাজ্যে আপনার সব ব্যক্তিগতই যে সোশাল মিডিয়ার নিয়ন আলোয় পণ্য হয়ে উঠেছে সে খেয়াল রাখা আপনার পক্ষে অসম্ভব। 



তাহলে এই সোশাল মিডিয়ার যুগে স্বাধীনতা বলতে আপনি কী বুঝছেন? বুঝছেন চ্যাটবট‌। আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স। রোবটরাই হয়ে উঠবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি থেকে দাগী অপরাধী সবকিছুই। মানুষের আর প্রয়োজন পড়বে না। সত্যজিৎ রায়ের 'অনুকূল' রোবটের আড়ালেও মানবিক গুণ বহন করেছিল, এই রোবটরা মানবিক হবে না ঘাতক হবে, তাও রাষ্ট্রই ঠিক করবে। অবশ্য ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠতেই পারে রোবটের দল‌। আপনার রাগ হলে আপনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গাল পাড়তে পারেন, সে স্বাধীনতা আপনার আছে। তার উত্ত‍র দেবে ট্রাম্পের চ্যাটবট‌। আপনি কল্পনা করবেন এই তো আসল ট্রাম্পের সঙ্গে আপনার বাৎচিৎ চলছে। যেমন সেক্স রোবটের সঙ্গে সঙ্গম করাকালীন মানুষ ভুলে যাচ্ছে তার একাকীত্ব। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন হস্তমৈথুনরত মানুষ আসলে যৌনতার সামাজিক কৌম থেকে বঞ্চিত। তিনি সেক্স রোবট দেখলে কী বলতেন?



আপনার স্বাধীনতাবোধ আসলে একটা মূর্খের স্বর্গবাস। একধরনের ইলিউশন। আপনি ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের মোকাবিলা করতে পারেন, সেন্সরের কাঁচি উপেক্ষা করে স্বাধীন সিনেমা বানাতে পারেন-আরও কত কী! কিন্তু তারপরেও আপনি দিনের শেষে চান আপনার একান্ত একটি পরিসর। সেই পরিসরে জেগে রয়েছে বিগ ব্রাদারের সর্বব্যাপী চোখ। আপনি কড়া নজরদারিতে আছেন, আপনার আমার সকলের স্বাধীনতা তাই আপেক্ষিক। মধ্যপ্রাচ্য এবং কাশ্মীর মণিপুরের থেকে খুব দূরে নেই আপনি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিপ্লবের সময় ভীত সন্ত্রস্ত সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করল, অথচ ইন্টারনেটের মাকড়সার জাল তার ব্যবহারকারীদের ব্যবহার করে চলেছে প্রতিনিয়ত, তামাম বিশ্বের সব সরকার বাহাদুররা তাও বুঝতে পারছেন। জলে রাষ্ট্রের কুমীর, ডাঙায় বসে প্রযুক্তির বাঘ- এই আপনার স্বাধীনতা!

ছবি সূত্র- Google 

মন্তব্যসমূহ

Prodip de বলেছেন…
খুব ভালো লাগল লেখাটা।

জনপ্রিয় লেখা