প্রত্যয় দাস
সোনার হরিণের মতো পথ
দেখাচ্ছে ‘কিশোর বিদ্রোহ’
ছাত্র আন্দোলন আগে
সাদাকালো টেলিভিশনে দেখা মিললেও এখন মাঝে মাঝে আন্তোনিও গ্রামসির হিজেমনি তত্ত্বের
প্রভাবে তা দেখা যায় চকচকে মনিটরের পর্দায়। এভাবে শুরু করার দুটি কারণ হল আনন্দ
এবং হতাশা।
প্রতিবাদ অথবা বিদ্রোহ এই
দুই ভাষা সৃষ্টিরই মৌলিক বস্তু ক্ষোভ। যেখানে আওয়াজ, ভাষা, কলম বা লিপিবদ্ধ প্ল্যাকার্ড হয়ে
ওঠে এক একটি অস্ত্রসুলভ সোনার হরিণ। এই সাম্রাজ্যবাদী বর্তমানে ২০১৮ সালে
বাংলাদেশের কিশোর বিদ্রোহ নিয়েও এমন সোনার হরিণ এবং ক্ষুধার্ত বাঘ ছোটার নতুন ইতিহাস
তৈরি হয়েছে বলেই এই বিষয় নিয়ে হয়ত বিশ্লেষণ করবার সময় এসে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক
বাস্তবতা, ছাত্র আন্দোলন এবং ইতিহাস নিয়ে পর্যাপ্ত ঘাঁটাঘাঁটির
প্রয়োজন হয়ত হবে না।
তবে আন্দোলন সংগ্রাম
সমৃদ্ধ করতে ইতিহাস বোধ প্রয়োজন হবে।
প্রসঙ্গত ১৯০৮-এ ক্ষুদিরাম, এরপর ভগৎ সিং, ১৯৬৮-তে রাশিয়ার কিশোর বিপ্লব এবং বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৯-এর
গন-অভ্যুত্থানে ছাত্র আন্দোলনের সূর্যসুলভ উদয় আমাদের আশা জাগানো একেকটি ইতিহাস। বাংলাদেশে
গত ২৯ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কিশোর বিদ্রোহের দাবি ও সমাজ পরিবর্তনমুখী আন্দোলনে
মানুষের সমর্থন এমনই একটি উদাহরণ এই আধুনিক নির্লজ্জ পৃথিবীর বুকে। এই কিছুদিনে
ঢাকা থেকে বগুড়া, রাজশাহী থেকে সিলেট, দিনাজপুর
থেকে চট্টগ্রাম প্রায় সর্বত্রই হিরোক রাজার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইতিহাসে নাম লেখিয়েছে
এই দ্রোহের দাবিদাররা। দেখিয়েছে ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান’।
এরপরে নৈরাজ্যবাদ চলেছে, চলেছে হুমকি নির্যাতন ও
নিপীড়নে বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা। আন্দোলনের বাস্তবতায় যা প্রায়
সকল ফ্যাসিবাদের রুট লেবেল স্ট্র্যাটিজিক্যাল মুভ অর্থাৎ সাপের বাহুতে ব্যাঙের
মেল। এই আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কন্সট্রাক্টিভ দিকগুলো একবার দেখা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে মূলত গুজব একটি বৃহৎ অংশে স্বৈরাচারী ক্ষমতাচ্চ্যুত
করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। আর তাই ‘গুজব ক্যান বি বোথ কনস্ট্রাকটিভ অ্যান্ড
ডেসট্রাক্টিভ’। গুজব তাই সামাজিক যোগাযোগ ও আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার ভিত্তিও হয়ে ওঠে।
তবে বাংলাদেশে দেখবার মতো ছিল এই গুজবের ফ্যাসিবাদি রেজম। নানান চেষ্টার পর
আন্দোলনকে পরিপূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রধান অস্ত্র এটিই হয়ে পড়ে। মেইন্সট্রিম
মিডিয়া যখন ছাত্র আন্দোলনের পাশে নেই, তখন গুজব মূলত গন-যোগাযোগেরই
ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
এই প্রপাগান্ডা অথবা গুজব
যেভাবে কাজ করে তা নিয়ে খুব বিস্তারিত লেখা চমস্কি-হারম্যানদের এক দারুণ বই আছে। আজকের
লিবারাল রাষ্ট্রের কাছে ছাত্র আন্দোলন একটি ভীতিকর পরিস্থিতি। আর তাই কর্পোরেট
মিডিয়ার সাহায্য অপ্রতিসম হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জন্য। কিশোর বিদ্রোহ ২০১৮ এরই একটি
উদাহরণ।
আজকের বাস্তবতায় বর্তমানে
একটি স্বাধীন আন্দোলনে অভিজ্ঞতাজাত ভীতি আমাদের মধ্যে কাজ করে। অর্থাৎ, আন্দোলনের
ফল অন্যের ঘরে চলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে প্রগতিশীল বলে পরিচিতদের সবচেয়ে
বড়ো অংশই মনে করে যে-কোনো আন্দোলনই তাদের মতে ‘মন্দের ভালো’দের সরিয়ে এমন শক্তিকে
রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন করবে যা আরও ভয়াবহ।
বিশ্বজুড়ে দ্বি-দলীয়
রাজনীতি জারি রাখার জন্য যেসব অপশক্তি ও তাদের দেশীয় এজেন্ট কাজ করে, এদের চিন্তাপদ্ধতি সেই
তাদেরকেই সহযোগিতা করে। এর ফলে তারা মানুষের জাগরণ ঠেকাতে নতুন নতুন ভয়-ফ্যাক্টর
আবিষ্কার করতেই থাকে।
যা আমাদের সঙ্গে হচ্ছে, যার বায়োপলিটিক্সে বুর্জোয়া
নীতির বুদ্ধিজীবী প্রক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত সমাধানে ফ্যাসিবাদ টিকে থাকছে। এই
চিন্তাপদ্ধতির একটি ত্রুটির দিকও কিন্তু আছে, জনগণের রাজনীতি
বিকশিত হতে থাকলেও রাজনীতির মাঠের শক্তিবলয় সবসময় স্থির এবং অপরিবর্তিত থাকে। বরং এখন এভাবে ভাবা যায়, জনগণের প্রকৃত রাজনীতি এগিয়ে
গেলে রাজনীতির মাঠ থেকে ভাড়াটে আর সুবিধাবাদীরা প্রথমেই সরে যাবে, আর তার স্থান নেবে লক্ষ লক্ষ প্রকৃত দেশপ্রেমিক-মানবতাবাদী-গণ
সমাজতান্ত্রিক-কল্যাণময় চেতনার যুবক-যুবতী। বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের
মাধ্যমে ঘটা তরুণযুবক অভ্যুত্থান কিংবা রাস্তার নিরাপত্তার আন্দোলনে ঘটা কিশোর বিদ্রোহের
ইঙ্গিত রয়েছে। জনগণের রাজনীতি বিকশিত হলে এ থেকেই
গণঅভ্যুত্থান ঘটবে।
মডারেটপন্থী বা অ্যানার্কিস্ট
শ্রেণির ‘আই হেট পলিটিক্স’-এর যেই গোত্রকে ফ্যাসিবাদ সৃষ্টি করে চলছে বহু বছর ধরে।
অসেচতন সমাজবাদ প্রতিষ্ঠায়
আজকে বাংলাদেশের বাস্তবতায়, প্রধান
দলেরাই যেখানে জনগণের জন্য রাজনীতি করছে না, সেখানে
অভ্যুত্থান আশা করাটা গড গিফটেড বা গডের উপর ভরসা করে রাখবার মতো ব্যাপার মনে হলেও
পরিবর্তন এখনই সম্ভব, এখনই শুরু। যেহেতু এই ‘হেট পলিটিক্স’
বা অ্যানার্কিজম ওতি বুদ্ধিজীবীমনা শ্রেণিটাকে মাঠে নামানোর জন্য সরলিকরণ পন্থা
অসম্ভব। ব্যক্তি ক্রাইসিসে এরাও সেই বিপ্লবের স্বপ্নই দেখতে শুরু করবে খুব শীঘ্রই।
আজকের বাংলাদেশীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নিজেকে নিজের থেকে বড় ভাবা একটি
মানসিক অসুস্থতা ও দেউলিয়াত্বে এসে দাঁড়িয়েছে। হিটলার এই রোগেরই শিকার হয়েছিল। এই
রোগের বহিঃপ্রকাশ অসহিষ্ণুতা আর হিংস্রতার লক্ষ্ণণ। পতনের অন্যতম লক্ষণও এটিই। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, একটি বিকল্প সৎ সাহসী নেতৃত্ব গড়তে শুরু
করলেও বিপ্লবের ফসল চেটে খাওয়ার দল বা ব্যক্তি বাড়ছে বেশি। সকল আশা আলোর মাঝেও
ইচ্ছাকৃত অন্ধকার একটি রাষ্ট্র যদি সত্যি তার শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করে থাকে, তবে এর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল
সেই উন্নয়নকে সার্বজনীন করা, অর্থাৎ এলিট থেকে সাধারণ সকল
মানুষকে সেই এক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে আসা। যার আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায়
শিক্ষার একমুখীকরণ। অর্থাৎ, যেই বাংলাদেশের প্রায় ১৫-২০ শতাংশ মানুষ মাদ্রাসা
শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে প্রায় অকার্যকরী এক পদার্থে পরিণত হচ্ছে এবং ঢলে পড়ছে
জঙ্গিবাদ সহ নানান অপকর্মের দিকে, তাদের সঠিক জনশক্তিতে
রূপান্তরের চেষ্টা।
গণ আন্দোলন বা ছাত্র
অভ্যুত্থান অধিকার আদায়ের পথে যুগে যুগে পৃথিবীর মানচিত্রে যেমন প্রগতির চিহ্ন
রেখেছে তেমনিভাবে হাজারো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মাঝে ‘বাংলাদেশ কিশোর বিদ্রোহ’ও একটি
দাগ কেটে যাবে সোনার হরিণের মতো এই সাম্রাজ্যবাদী সুবিধাবাদী একটি ইচ্ছুক
অসভ্যপ্রায় উপমহাদেশের বুকে।
মতামত লেখকের নিজস্ব
মন্তব্যসমূহ