সায়ন্তন ঠাকুর



আঙ্গিক ব্লগ, জুন ২০১৮

বাংরিপোসি রেস্ট হাউস

১.

খর রোদ্দুরের মাঝখানে বয়ে গেছে রাস্তা। দুপাশে ফুটে আছে উত্তাপ। বয়ে গেছে মানুষজন কোলে নিয়ে ঠাণ্ডা সেডান। রাম নবমীর জৌলুস এবং মুখে স্কার্ফ জড়ানো যুবতির দল। তারা চলে গেছে সেই কোন সকালে। তখন দিঘীর জলে টলটলে পদ্ম বেঁচে ছিল। এখন শুধু হাহাকারময় বাতাস, রাস্তার ওপর শুয়ে আছে গরম আলো।ঠাকুরাণি পাহাড়ের চুড়োয় মহুয়া ফুল ফুটেছে খুব। শাদা কুসুমে কুসুমে ছেয়ে আছে বনান্ত। ওই রাস্তার সঙ্গে তাদের পিরিত হয়েছিল গত মার্চে। একটা লোক হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে সেই রাস্তা। নীল পাঞ্জাবি মুছে যাচ্ছে লাল ধুলোয়। সব সম্পর্ক ফেলে রেখে মিশে যাচ্ছে পাথরে তার পায়ের ছাপ। আজ রাতে সিমলিপাল থেকে বৃষ্টি আর দুমুঠো বিদ্যুৎ নিয়ে আসার জন্য সে হেঁটে চলেছে দ্রুত। খর রোদ্দুর ছাতা হয়ে ফুটে আছে লোকটির মাথায়।

২.

সবুজ দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকলেই ভেসে আসে পুরোনো জনপদের ছায়া। ধূ ধূ বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা শাল গাছের হলুদ পাতার শব্দের নীচে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি আর গ্লাস নিয়ে বসে আছে এক বুড়ি। খড়ি ওঠা কালো চামড়ায় জেগে উঠেছে ধমনীর নদীখাত।সে নদীর নাম ডুলুং। সবুজ দরজা পার হয়ে তার কাছেই আসতে হয় বারবার।নদীর পাশে চেয়ার পাতা, ভারী কাঠের টেবিলে ঠাণ্ডা একগ্লাস জল, লেখার খাতা, ভারী ঝর্ণা কলম পরিপাটি করে সাজানো। পুরোনো ভালোবাসার মতো তার পাশে একমুঠো ধুতরো ফুল ছড়িয়ে রেখেছে কে যেন! নদীর ওপারে ঝলমল করছে নীল এটিএম। গত শীতে যে ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড হারিয়ে ফেলেছি স্বেচ্ছায়, এটিএম মেশিনের গায়ে আটকে আছে তারা। কিন্তু সন্ধে হয়ে এসেছে আজ। এপারে তুলসী তলায় জ্বলে উঠেছে প্রদীপ। গুমগুম শব্দে মেঘ জমছে ওই টেবিলে। মাধবীলতা আর চন্দনের গন্ধে বন্ধ হয়ে গ্যাছে সবুজ দরজা। কোথাও যাওয়ার নেই আমার। কত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, কত জ্বলন্ত বুদ্ধ বিহার, আগুন লেগে যাওয়া গেরস্ত উঠোন, কত একাকী সজল জানলার মুখে লেগে থাকা আফ্রোদিতির মুখ, অশ্বারোহী সেনা সব পার হয়েই তো আজ এই সন্ধের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। কোথায় যাব আর ?
রিজার্ভ স্লিপ ছাড়া অনধিকার প্রবেশের যা শাস্তি হয়, তুমি দাও, রেস্টহাউসের চৌকিদার, তুমি শাস্তি দাও আমায়। নির্বাসিত কর আমার সব কারুবাসনা।

৩.

বাড়ি ফিরছিলাম আমরা।ট্রেনের খোলা জানলা বেয়ে ধেয়ে এসেছিল ঘন রাত্রির আকাশ।অতিকায় বৃশ্চিক শুয়ে ছিল সে আকাশে।বাতাসে এলোমেলো আমাদের মুখ।কেউ কাউকে যেন চিনতেও পারছি না। শুধু এটুকু মনে আছে আমাদের জুতো, জামাকাপড়ে লেগে ছিল লাল ধুলো। দুপুরে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। কংকালীতলার শ্মশান, বল্লভপুরের জঙ্গল, কোপাইএর রুগ্ন জলধারা ভেদ করে কাটিয়েছি একটা গোটা দিন। চোখের সামনে নেমে এসেছে হলুদ রঙ। এখনও আমার নীল হাফশার্টের বুকপকেটে পড়ে আছে দুটো শুকনো পাতা। সস্তার পাইস হোটেলে খেয়েছি শাকান্ন। তুমি তারপর মুখে দিয়েছ খয়ের, একশো বিশ জর্দা দেওয়া বাংলা পাতির সবুজ পান। লিপস্টিকের ওপর চেপে বসেছে খয়ের। বাদামী রঙের চুলে লেগেছে ধুলো ওড়া বাতাস। টলমলে পুকুরে দেখেছি নিজেদের ছায়া। ছায়ার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে সুপারি গাছ। এর আগে তুমি কখনও পানকৌড়ি দ্যাখোনি। সূর্য দিগন্তরেখাকে ছুঁয়ে ফেলার একটু আগে মাটির ভাঁড় নিয়ে বসেছি দুজনে সুবল বৈরাগীর দোকানে। পশ্চিমদিকে তখন অলৌকিক বিভা। তার আঁচে ঝলমল তোমার মুখ। তোমার সামনেই আমি। কিন্তু চিনতেই পারছ না আমাকে।কতদিন হয়ে গেল, যেন এভাবেই একলা বসে আছো তুমি। অস্তগামী আলোর রেণু মেখে সমস্ত শরীরে। 
                                  তবুও ফিরতে তো হবে আমাদের। পালিয়ে এসেছিলাম আমরা যে একটি দিনের লোভে, শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। পাঁচটা  পঞ্চাশের ট্রেনে এবার ফিরতে হবে আমাদের। শোনো, কে যেন গাইছে, বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা!

৪.

হটাৎ কোনও ছবির রোগা ডিঙি নৌকোয় চেপে পুরোনো একটা দিন ভেসে আসে। অতি শীর্ণ বুড়িবালাম নদীকে সামনে রেখে চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে দৃষ্টি পেতে রাখে যে দুটি চোখ, তারাও ভেসে আসে। পঁয়ত্রিশ মিলিমিটার লেন্স তার আলো প্রবেশের গর্তের পরিধি বাড়িয়ে পিছনের সবকিছু ঝাপসা করে দেয়। শুধু জেগে থাকে দুটো চোখ, হীরে ঝলমলে নাকছাবি,দীর্ঘ চুলের রাশি এবং কিছু গল্প বলতে চাওয়া উৎসুক দুটি চুম্বনযোগ্য ঠোঁট। মুছে যায় পিছনের নদী, লাল মাটির নিশানা, ফাল্গুন মাসের দুপুর, সময়ের গায়ে লেগে থাকা জলছাপ, সবকিছু মুছে যায়। অত কম ফোকাসে দেখা যায় না সামপ্লেস এলসে বাজতে থাকা জনি ক্যাশ। চুম্বনহীন শুকনো ঠোঁট ভুলে যায় চিলি বিফ অথবা ফিশ ওরিলির স্বাদ। কাঁসার থালা ভর্তি পঞ্চব্যাঞ্জনও দেখা যায় না সে ছবির আনাচে কানাচে। আরও রাত বাড়লে ঝড়বৃষ্টির শহরে পরমা আইল্যান্ড পার হয়ে ছুটে যায় যে দুধ শাদা উবের, তার গল্পও চেনা যায় না। কিছুই বোঝা যায় না ওই পুরোনো ছবির ফ্রেমে। ফোটোগ্রাফারও নিরুদ্দেশ অনেকদিন হল। তার লেন্সে এখন বিগত বর্ষার ফাঙ্গাস।যার ছবি,সে মাঝে মাঝে এখনও খুলে দ্যাখে। সে জানে নদী, অলৌকিক রেস্ট হাউস,সামপ্লেস এলস,ওই দুপুর, কালো লেন্স, ফুলের মতো লেন্স হুড সব তার মনে আছে। এমনকি ছবির ক্যাপশন আজ যেমন করে গাইছে আকাশের সুর অবধি তার মনে আছে। শুধু ওই অদেখা ফোটোগ্রাফারকে ভুলে গ্যাছে। আমূল ভুলেছে সে। মনে পড়ে না আর সব আলো অন্ধকার। তার সব মায়া।

৫.

ট্রেনের ভোঁ শুনলেই চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসে। রাত পার হয়ে সে ট্রেন জঙ্গল ঝোরা আর পুরনো মালভূমিকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে যায়। একটা নরম রোদ্দুর ওঠে চারপাশে। জঙ্গলের দোরগোড়ায় থমকে যায় সে শকটযান। কতদিন শোনা হয়নি শব্দ যখন সন্ধে নামার একটু আগে চরাচর জুড়ে নেমে আসে অপরূপ বেগনি রঙের আলো। কে না জানে ওসব ধূলিকণা আর প্রতিসরণের ম্যাজিক। তবুও তো আমরা বিশ্বাস করি, ভালবাসি সে বিশ্বাসঘাতকতা। অক্ষম চেষ্টা করি লেন্স খুলে তাকে চিত্ররূপময় করে তোলার। আরও কিছু অন্ধকার ঘন হলে প্যাট্রিক মূর্মু শোনায় তার প্রেমের গল্প। চার্চের গল্প। সে টাটা সুমোর ড্রাইভার কিনে আনে গরম শুয়োরের মাংস। আমি ভুলে যাই আমারও সংসার ছিল প্রতীক্ষা ছিল, শুধু আঁজলা পেতে শুষে নিই তার অতীত কিসসা। জানি তারপর আমাদের ফিরতে হবে সাতমাইল জঙ্গল ভেদ করে মহুয়ার হাতছানি পার হয়ে বনবাংলোর অন্দরে। শুধু পরদিন অচেনা নদীর রোগা জলধারায় ওপারে আরও একবার পুরোনো সূর্য উঠবে বলে ? নাকি গাছবাড়ির ঘুমে আমার আরও একটা রাত কেটে যাওয়ার কামনায় ? জানি না, ভালো মনে আসে না আর এখন। এখন আমার পার্সে চোরাগোপ্তা মিগ হানা দেয়, গর্জে ওঠে বফর্স কামান। চোখের তলায় জমে ওঠে লালজির হাতি খেদানোর গানের সুর। জ্বলে ওঠে আগুন। রোগা চৌকিদার বলে, শুয়ে পড়ুন সাহাব! বহুত আঁধিয়ার হে! 

আমার পায়ে অনতিক্রম্য শেকল। ছোট বারান্দার মুখে চুমু খেতে আসা বুড়ো ছাতিম গাছের ছায়ায় বসে মনে হয়, একদিন আমারও জমিজিরেত ছিল, গাজনের বাজনা ছিল, চড়কগাছ ছিল। মনে হয় আমারও প্রেমিকা ছিল, আফ্রোদিতি ছিল। বনপাহাড়ের কিনারে সাকিন ছিল আমারও। একদিন।

মন্তব্যসমূহ

SOUMANA DASGUPTA. বলেছেন…
খুব ভালো লাগল। লেখার হাত বড় মিঠে
Unknown বলেছেন…
ধন্যবাদ আপনাকে।

জনপ্রিয় লেখা