সমরজিৎ সিংহ
মিথ, রাম-রাজ্য এবং আমরা
রামায়ণ মহাকাব্য । না, ধর্মগ্রন্থ নয় । কাব্যে বা উপন্যাসে, ধর্মকথা থাকতেই পারে । এই রামায়ণের বহু বয়ান । বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণ আদি রামায়ণ বলে মান্যতা পেলেও, অন্যান্য দেশের বা অন্যান্য ভাষায় রচিত রামায়ণ অবহেলার নয় ।
আমাদের দেশে, বিশেষ করে, উত্তর ভারতে, রাম ঈশ্বর হিসেবে পূজিত । এই রাম বাল্মীকি রাম নন, তিনি তুলসীদাসের রাম । তুলসীদাসের রাম আসলে ব্রহ্মানন্দ পুরাণের রাম, তিনি ব্যাসকথিত, যা অধ্যাত্ম রামায়ণ হিসেবেও পরিচিত । রামচরিত মানস-এর রাম এখন রামানন্দ সাগরের কল্যাণে ভারতের মানুষের মানসপটে প্রায় স্থায়ী আসন লাভ করেছে । মানুষ বিশ্বাস করছে, মহাকাব্যের নায়ক আসলেই ঈশ্বর বা ঈশ্বরের অবতার ।
এই অবতারবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদের অবদান । বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে যুজতে না পেরে, তারা অবলম্বন করেছিল অবতারবাদের । এতটাই যে, গৌতমবুদ্ধকেও তারা অবতার বলে প্রচার করে । বৈষ্ণবকবি জয়দেব, তার গীতগোবিন্দম গ্রন্থে সরাসরি লিখলেন, কেশবধৃত বুদ্ধ শরীর জয় জগদীশ হরে।
এই বৌদ্ধধর্মে দশরথ জাতক রয়েছে । এটাও রামায়ণ, আর এই গ্রন্থে রাম এবং সীতাকে ভাই ও বোন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে । আবার তারা স্বামী-স্ত্রীও । এখানে রাম ঈশ্বর নন ।
জৈনধর্মেও পৌমচরিয়ম নামে এক গ্রন্থ রয়েছে, যা মূলত রামায়ণই । এই গ্রন্থে রাম ঈশ্বর বা নায়ক নন, তিনি এক মরণশীল মানুষ । বরং, এই গ্রন্থে রাবণ এক মহামানব ।
আমাদের মনে রাখা দরকার, ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল আধিপত্যে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ ত্রাহি ত্রাহি জীবন যাপন করত, এই বৌদ্ধ ধর্ম এবং জৈনধর্ম হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল । গৌতমবুদ্ধ ঈশ্বরবাদকেই নস্যাৎ করেছিলেন । সুতরাং রাম, স্বাভাবিক কারণেই, তাদের কাছে ঈশ্বর নন ।
বলা বাহুল্য, এই ঈশ্বরবাদ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের এক বড় অস্ত্র, যা পুরাণাদি গ্রন্থের মাধ্যমে ভারতবাসীর মনে সঞ্চার করেছিলেন । বাল্মীকির রামায়ণ আদিতে এক লোকগাথা ছিল বলে অনেকেই দাবি করছেন এখন। শুধু তাই নয়, বাল্মীকির অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে । বলা হচ্ছে, ইউরোপের কল্মীক অঞ্চলের লোকজনকে বল্মীক বা বাল্মীকি বলা হয় । এর সমর্থনে লেখালেখি হচ্ছে বিস্তর ।
প্রশ্ন সেখানে নয়, প্রশ্ন হল, লোকগাথা নায়কের এই ঈশ্বরত্ব লাভের পেছনে কি ছিল ? কেবলই ভক্তি ? অধ্যাত্ম রামায়ণ এই ভক্তির বীজ পুঁতেছিল, যদিও বিষ্ণু পুরাণেও রামকে ঈশ্বর রূপে বর্ণনা করা হয়েছে ।
আগেই বলেছি, পুরাণ গ্রন্থগুলিই ঈশ্বরবাদের মূল প্রচারক । এটাও ঠিক, অধিকাংশ পুরাণ রচিত হয়েছে খ্রীষ্ট পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম যখন ভারতে প্রবল এবং অধিকাংশ রাজপৃষ্ঠপোষকতা তারা অর্জন করেছেন ।
এখানেই লুকিয়ে আছে রামের ঈশ্বরত্ব লাভের রহস্য । আর্যদের অনার্যবিজয় নিয়ে যে লোকগাথা, তার নায়ককে সামনে রেখে, ভক্তিবাদকে মূলধন করে, বৌদ্ধদের সঙ্গে না লড়লে, ব্রাহ্মণ্যবাদ ভারতের মাটি থেকে উৎখাত হতে পারত । জাভা বালি প্রভৃতি দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদ টিকে থাকতে পারেনি, কেন না, সেখানে এই ভক্তিবাদ কার্যকরী করা যায়নি । সেসব অঞ্চলের রামায়ণ ফলে আলাদা ।
রাম অবতারপুরুষ বা ঈশ্বর, এটা উত্তর ভারতে যতটা মান্যতা পেয়েছে, ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকায় ততটা মান্যতা নেই । বরং সেখানে কৃষ্ণের দাপট বেশি । মহাভারতে কৃষ্ণের প্রবেশ দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরসভায় । এর আগে, কোথাও কৃষ্ণের উল্লেখ নেই । এই কৃষ্ণ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ঈশ্বর রূপে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে । অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শন করাবার মাধ্যমে ।
রাম নিজেকে এভাবে প্রতিষ্ঠিত করেননি, বা লোকগাথাগুলি তা চায়নি । লোকগাথা না চাইলেও, ভারতে এখন রামকে নিয়েই যত জটিলতা । মহাকাব্য বলি, লোকগাথা বলি, রাম এখন মীথ । এই মীথকে কাজে লাগিয়ে একটি রাজনৈতিক দল ভারতের ক্ষমতায় বসেছে । তাদের দাবি, রামায়ণে যেহেতু অযোধ্যা দশরথের রাজধানী হিসেবে বর্ণিত ছিল, সুতরাং অযোধ্যা রামের জন্মস্থান । এই দাবির পেছনে যুক্তি নেই, রয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধিপত্যবাদ । বৌদ্ধধর্মকে বিনাশ করতে, একদা, তারা যা করেছিলেন, সেই হিংস্রতা তারা পুনরায় ছড়িয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
মন্তব্যসমূহ