দিব্যেন্দু দলুই
নববর্ষ ১৪২৫- ১১
কবিতা ১
যুদ্ধের বিরতি মেনে শুয়েছি রিক্সার ছেঁড়া সিটে
বিড়ি জ্বালতে ভয়, বুঝি গাছের কোটর থেকে
পাতার রহস্যজট থেকে
চুক্তি ভেঙে ছুটে এল গেরিলা বুলেট
পা টিপে টিপে কারা হাঁটছে, কারা আড়ি পাতছে বুকে
প্রতিটি গবাক্ষ, সিঁড়ি, অলিগলি শিরা-উপশিরা
মহল্লার সব দোকানপাট
পুষে রাখছে হিংসা, জ্বর, বোমা, বিষ্ঠা, সায়নাইট দানা
শরীরের প্রতিটি কানাচ খবর আনছে অসুখের
মগজে সৈনিক, মদ, রোস্ট-করা মুরগিদের ঘুম
রাত মাত্রেই প্রতারক জানি
যা-কিছু কাঙ্ক্ষিত হিমগৃহের
শাদা ও সংযত
পরিধির বাইরে টেনে নিয়ে যেতে পারত এই লাশ
মায়াবী ম্যানহোল ঘেঁষে আহত রিক্সার প্ররোচনা
কিংবা শ্যাওলাকলোনির ঝুলন্ত টয়লেট জুড়ে ক্ষত
পেচ্ছাপের দ্রোহ বা দুর্গন্ধ শ্যাম রেখাচিত্রলিপি
আরও হলুদ প্রচ্ছদে
মাছিদের বিষাদসমগ্র ডিটিপি অপ্রকাশিত গান
কানে তার গুঞ্জন থামেনি
যুদ্ধের বিকল্প যুদ্ধ জারি আছে দেহের ভেতর
তাই বিড়ি জ্বালতে ভয়, তাই ঢিল ছুঁড়ে নেভাতে হলো চাঁদ…
লুকোনো যে-ল্যান্ডমাইন, জালনোট ছাপার যে-মেশিন
হৃদয়ে, বালির নীচে দীর্ঘদিন চাপা পড়ে আছে
টিউকল খোঁড়ার ছলে জেহাদি জলের দাবিসহ
তাদের আজ তুলে আনব কিনা
ভাবতেই ঝাঁকুনিময় পাবলিক বাসের জানলা থেকে
ছুটে এল মুরুব্বি ও মরিয়া বুলেট
শ্রদ্ধায় চোখের পাতা ভারী হয়ে নেমে এল নীল যবনিকা
চোখের দোষ নেই, তবু চোখের নিয়তি এই রাত
কুঁকড়ে, অন্ধ, শীতকাতর, শুয়েছি রিক্সার ছেঁড়া সিটে
মগজে সার্কাস, তাঁবু, খঞ্জনিবাদক শেয়ালের
ভিড়, ভাষণ, লাল বেলুন, পল-সায়েন্স ক্লাস
করোটির শামিয়ানা বৃষ্টিকে ব্যাহত করেছিল
না-হলে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ত ফুলের টব গাড়িবারান্দায়
কবিতা ২
ঘুড়ি + মেঘ = স্মৃতিকাতরতা
ভুলে গেছি রোদ, টিলা, টেলিফোনের তার
ছিঁড়ে পড়ে আছে ভাঙা মাঠে ও বিকেলে
দখিনমুখে জনহীন রেলের কোয়ার্টার
ফাটলে স্মৃতি ও সাপ লুকোচুরি খেলা
ছোটো ছোটো ঝোপগুলোর বালিধুলোমাখা
লাল বিষাদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেঁকে গেছে পথ
পথ বলতে প্রবণতা, টিলা থেকে নেমে
দুর্ধর্ষ দাপুটে সব দিনগুলো যেমন
ক্যাডার থেকে বদলে যাচ্ছে নিঝুম শীতের
বার্ধক্যপীড়িত সব রাতে, জোছনায়
বাবা কবেই ছেড়ে গেছেন চাকরি আর চাঁদ
এখন মা-ও সেলাইকল, কাশির ওষুধ
বালকের খেলনা রেল পুতুলশহরে
জংশন জংশন ঘোরে… ভাঙা কোয়ার্টার
মিলিয়ে যায় নিমেষেই, তবু একপলক
মনে হলো, হাফপ্যান্টে আমারই ছেলেবেলা
নিষেধ ঠেলে ভরদুপুর ভাঙা পাঁচিলের
বাঁ-হাতে কাগজে-মোড়া ঝালনুন, ডানহাতে
ঢিল নিয়ে পেয়ারা পাড়তে ঢুকে পড়ছে, একা
কবিতা ৩
তোমার নিঝুম স্তন মুখে নিয়ে কেটে যায় সন্ত্রাসের রাত
বিছানা চাদর যত ওড়ে যত চাঁদের ব্লিডিং হতে থাকে, অশ্রু আর ফিনাইল
সেম বলে মনে হয়, তুমি সমস্ত লাগেজ নিয়ে কলোনির মাঠে
হসপিটাল হয়ে ওঠ দ্রুত
আমিও জ্ঞানের সাথে গন্ধক পাইল করে ফেলি, কেউ তো আমার কাছে
কেউ তো শোনে না, শুধু বিগবাবুল চিবোতে চিবোতে ভিড় জমায়
চৌবাচ্চার ভেতর, তবে আমি কার পাড়ায় যাব, কাকে ডেকে হাতেপায়ে ধরে
দু-চার পেগ চাখতে বলব কবিতা, আমার তো জিরাফের পৃষ্ঠপোষকতা নেই
তোমার নিঝুম স্তন মুখে নিলে কলমের ডগা
শিরশির করে ওঠে, কিন্তু কোনও জন্ম আজ স্বাভাবিক নয়
টেস্টটিউব নিয়ে জেগে আছি অপেক্ষায়, জ্বরে
কসাই, দালাল, শঠ, বিধায়ক, শৃগাল, পুলিশ, পুরোহিত, ভণ্ড, জুয়াচোর
পাতালব্যাপী কালো কুয়াশার ঘুর্ণি থেকে উঠে এসে
কবিকে লেকচার শুনিয়ে গেল
কবিতা ৪
আমারও জুটেছে পুনর্বাসন বগল বাজাতে বাজাতে
নিজস্ব খেত, ঢিবির মাথায় নিজস্ব তালগাছ
আর তালগাছে নিজস্ব বাসা, জোনাকি-সাজানো বেডরুম
নীলাভ-সবুজ আলোতে হাসিতে মগ্ন
আর চাঁদের ভিতর বিরাট কেবিন, কাগজ কলম ল্যাপটপ
এক তুড়িতেই কাটলেট, কফি, এক তুড়িতেই যা-কিছু
ওষুধপত্র, চাকরবাকর, পথের খরচ মাগনা
রোজ নতুন নতুন যূথিকা টগর সুবাস ছড়াতে আসছে
এবার পুজোয় ডজন ডজন ঘুড়ি কিনে বাড়ি ফিরছি
পরিচিত সব গাছেরা আমায় টেরিয়ে দেখছে ভীষণ
কবিতা ৫
প্রেম তোমায় বাঁচাবে না
প্রতিশ্রুতিহীন এ-শহরে
বেজে বেজে কেটে যাবে ফোন
সবকিছু ডিনাই করতে পারবে না তুমিও
সবার মুখে থুতু দিয়ে প্রেমিকার হাত ধরে
পালাতে পারবে না
ধানখেতের মাঝখানে আলপথ দিয়ে দিগন্তের দিকে ছুটে-চলা ট্রেনগুলোর ল্যাজ
এখানকার জংশনে বাঁধা
এখানকার থিয়েটারে গবেট পেয়াদা হয়ে
রয়ে যেতে হবে আজীবন
প্রেম তোমায় বাঁচাবে না
হাততালি তাড়িয়ে নিয়ে যাবে
সবকিছু ডিনাই করতে পারবে না তুমিও
নির্জন গাছের কাছে গিয়ে বলতেও পারবে না সব কথা
কাঁদতেও পারবে না একা নির্জন নদীর কাছে বসে
কারণ ফেসবুক ছাড়া কান্নার প্রকৃত পরিসর
কোথাও রাখেনি এ-শহর
মন্তব্যসমূহ