তন্ময় ভট্টাচার্য-র নির্বাচিত কবিতা (প্রকাশিত ও গ্রন্থিত মিলিয়ে)
নববর্ষ ১৪২৫- ১৪
পদাবলি
এই যে অপেক্ষারতা
পরপর ট্রেন ছাড়ে
ফুটব্রিজে হাওয়া দেয় রোজ
কানুয়া তো বাঁশি হাতে
দু'হাজার বছর নিখোঁজ...
খ্রীষ্টপূর্ব
অর্ধচন্দ্রাকারে চোখের ওপরে কেন মাতিয়ে রেখেছ খোলাচুল
আমারও তো ভুল হয় - হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার মতো ভুল
সেই থেকে একে একে ঘোড়ায় চড়া শিখেছি, তামা ও লোহার ব্যবহার
তখনই কাঁচুলি পরে কটাক্ষ ছড়িয়েছ - মন আর বসেনি আমার
শিকারও পালিয়ে গেছে। শূন্য হাতে ফেরার গঞ্জনা দু'চোখে ঘনায়
সূর্য সাক্ষী, আমি বুঝতে পারিনি কারা সোনার হরিণ হয়ে যায়
অথচ নদীর পাড়ে পরিধান খুলে রেখে সাঁতার কেটেছ ক্রমাগত
কী করতে, মঞ্জুলা, অসভ্য মানুষেরা যদি না আমার মতো হত...
অতর্কিত
সুলোচনা, ভুলে যাও দেখা হয়েছিল এর মধ্যে
ভুলে যাও বসেছিলে উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে
অসময়ে ট্রেন চলে এসেছিল - ভুলে যাওয়া প্রয়োজন
কেননা আমার আজ তিনমাস হল কোনো ঘর নেই
সুলোচনা, ভুলে যাও রোদ পড়েছিল রেললাইনে
ভুলে যাও সিগন্যাল সবুজ হয়েছে বড় জলদি
চশমার অজুহাতে কতবার দেখেছ কটাক্ষে
তাড়াতাড়ি ভুলে যাও - আমিও অকল্যাণে মন দিই
চলে যেতে যেতে ফিরে আরেকটু উঁকি মেরে দেখলে
বোঝা যায়, কত কথা এখনও বলার মতো জমানো
অথচ ওই যে বাঁক - ঘুরে যাও চূড়ান্ত ডাউনে
সুলোচনা, জানি তুমি বিশ্বাস করো ট্রেন দাঁড়ানোয়...
জলছাপ
তোমার বিয়ের দিন
যে কোকিল কেঁদে ওঠে
বোলো না, বসন্তের দেরি আছে এখনও অনেক
সে কাঁদুক, কেঁদে যাক
কাঁদতে কাঁদতে তার
রাধাচূড়া গাছ থেকে পাতা ঝরে পড়ুক আবার
তুমি বোলো, শীতকাল। আড়ালে কোটর মুছে নিও।
কলোনি
এপাশে ঝিলের মাঠ, ওপাশে সদ্য পাকাবাড়ি
জানলা খোলাই থাকে এ জাতীয় ঋতুর প্রকোপ
খাতা নিবিষ্টমনে পড়ছে যে ফুলেল কিশোরী
ভয় নেই, সে এখন চোখ তুলে দ্যাখে না ফেরানো
নিশ্চিন্ত হেঁটে গেছি, প্রতিটা মোড়ের কাছে পাখি
বলছে কোথায় গেলে তীব্রতর আশা হারানোর
আলোটি জ্বলছে ঘরে, বহুদিন তাঁহাকে দেখিনি -
'ঘোলাটে দেশের ছেলে, বলো হে বাঙালভাষা বলো'
দাম্পত্য
আমি ও আমার জানলার কার্নিশে
একটি বিড়াল - সুন্দর সংসারী
আমাদের কোনো দ্বিতীয় পক্ষ নেই
বাইরে বৃষ্টি সতীনের মতো যেন
বিস্কুট ভেঙে আমরা দু'জনে খাই
গা ঝাড়া দিয়ে ও নিজের হাত-পা চাটে
আমি গান গাই। কবিতা আমার প্রিয়
বাধার বদলে বাহবা জানায় শুধু
পর্দা সরিয়ে তাকিয়েছে গাঢ় চোখে
চিনেছি নিশীথ রংবদলের খেলা
একটি বিড়াল কত সুখী হতে পারে
আমাদের কোনো বিয়ে-টিয়ে হয়নিকো!
যেটুকু রং
তোমায় না-দিতে পারা এখনও নখের কোণে লাল
মধ্যে বছর গেল। স্বীকার জানাতে এসে
ভাঙন, তবুও কেন প্রাণপণ মানেনি কপাল
আবির মুঠিতে ধরে, গ্রামের অচেনা পথে
বীভৎস ছুটেছে সে; তুমি কই, তুমি গো কোথায়
শুধু চিহ্ন শুয়ে আছে। শ্মশান চতুর্দিকে।
পা ছুঁয়ে যেটুকু রং হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া যায়...
কুলদেবতা
সত্তর বছরের পুরনো বাসন
ঘষেমেজে চকচকে করেছি। এবার
ভোগ দেওয়া যেতে পারে। রুষ্ট হবেন কিনা
জানা নেই, তবে ভরসা, পুঁটুলি গুছিয়ে
তিনিও তো এসেছেন, সেবারেই, একই ট্রেনে চেপে
সাইকো
বিখ্যাত কবিদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে নামিয়েছি
তোমার বিছানা থেকে। আর যদি কোনোদিন দেখি,
রক্তারক্তি হবে। সমস্ত ছেঁদো কথা -
কীসের প্রতিভাবান! কে পূর্বসুরি!
আমার তুলনা তোকে করতে দেব না মুখপুড়ি
দাহকর্ম
আমি সে মুহূর্তের অপেক্ষায় আছি -
গঙ্গাকলস হাতে
আমারই কবিতা থেকে
বলে উঠবে গ্রামীণ পুরুত!
শহরতলি
এই রাস্তা শুনশান। হলুদ আলোর কিছু
কথা ছিল, পারেনি এমন
শীতের ফসল এই আগুন
টায়ার-পোড়া ঘ্রাণ
পিছনে ফিরবে - স্থির বিশ্বাসে হুড খোলা
কী দ্রুত বয়স গলে জল
একা ছাড়লাম
ওকে পৌঁছে দেবে না, করতল?
অন্নপ্রাশন
অন্ন দিই মুখে তোর; কন্যা তুই বীজমন্ত্রে থাক্
আরও সন্ধ্যা আরও ভোর ব্রাহ্মণীর শিকড়ে জড়াক
পুরাণে পচন ধরে; কন্যা তুই সীতামাত্র নোস্
নিকটে স্বীকার করি যা পিতৃব্য, কালসর্পদোষ -
বাকি ধন্য অনুগ্রহে; আয়ুবৃদ্ধি হোক কন্যা তোর
জন্ম সাক্ষী মেনে আজ রাখিলাম এ-ক'টি আখর
খনন
এসো পূর্বসূরী দিন, মহাসিন্ধু, আমি তার যে-কোনও বিপৎকালে শরণার্থী হয়ে আরও বিপদ বাড়িয়ে দেব; যেন সে আমার দিকে নিরাসক্তি তুলে বলে – কেউ নও, শুধু বৃক্ষ হয়ে গেছে আমাদের নাম। আমি সে-নামের দিকে কত সন্ধ্যা কত রাত এরপর ধাবমান – আশা ও প্রভূত লোভ – অভিশপ্ত প্রেতটিকে গয়াতীর্থ নেবে না, পাঠক? নিজেরই স্বার্থে তাই বালি খুঁড়ে তুলি জল – ওঁ শুচি ওঁ শুচি, বৃক্ষে উপুড় করি; সে আমার ঘাটকাজে একমাত্র অধিকারী হোক...
(‘দীপাবলি নাকি শবযাত্রা’ থেকে)
কেমন আছ
...সেটা বড় কথা নয়! ওসব ভাবতে নেই বেশি
আসলে ভালোইবাসে। ছেড়ে দিলে দাঁড়াব কোথায়
পেটে একটু মদ গেলে কেমন শিশুটি হয়ে যায়
পুরুষমানুষ, তাই ক্ষমাঘেন্না কী আর এমন
আঁচলে ঢেকেছি লাল, দাগ বুঝি অতই গভীর
একটু মারেও যদি, সহ্য করার পরে আলো...
তুমি কী করবে শুনে? পালাতে বলেছি, পেরেছিলে?
(‘দীপাবলি নাকি শবযাত্রা’ থেকে)
উপদেশ
রে শব্দ, তোরে আমি বারবার বুঝায়েছি, বাচালতা করিবি না কোনও
অতিরিক্ত এতটুকু যেন না প্রকাশে আসে, দুর্বল বাহিরিয়া পড়ে
চতুর উহারা, অনুমানক্ষম; স্পষ্টত বুঝিবে যে ভালোবাসিয়াছি
অতঃপরের কথা শোকস্তব্ধ, ফলপ্রসূ যারা হয় না কদাপি
রে শব্দ, সারমেয়, পথিপার্শ্বে চিৎকার, ধমক খাইলে গুটিসুটি
পুনশ্চ বাহিরিব, মূক ও বাচাল - মোরা একই অঙ্গে সনাতন দুটি!
(‘দীপাবলি নাকি শবযাত্রা’ থেকে)
মন্তব্যসমূহ