ঋদ্ধিবেশ ভট্টাচার্য্য
শরীর: একটি ভাষামাধ্যম (Body language as a language)
“শরীর খানা গড়ো, আগে শরীর গড়ো
নইলে পরে সব ভন্ডুল আর যা কিছু কর।”
হেমন্ত মুখার্জির এই গানটি আমাদের জীবনের এক চরম শিক্ষার কথা অত্যন্ত মজার ছলে খুব সহজে বলে যায়। সেই শিক্ষাকেই আজ আমি একটু তলিয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কিঞ্চিৎ অ্যাকাডেমিক কচকচানির সাথে আলোচনা করব। সেই আলোচনা সূত্রেই আমাদের বর্তমান বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারের যেটুকু সামান্য অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে তার উল্লেখ আমি করার চেষ্টা করব।
আমার সাথে এই ভাবনাটির পরিচয় ঘটে ২০১৪ সাল নাগাদ। নির্ণয় নাট্যদলের একটি কর্মশালায়। সেই কর্মশালার বিষয় ছিল অঙ্গ সঞ্চালন (Movement) এবং পশ্চিমী নৃত্যচর্চা। এই কর্মশালার পরিচালনা করেছিলেন সিলভিয়া ভোনা। সিলভিয়া জন্মসূত্রে ইতালীয়, তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ ভারতবর্ষে থেকে ওডিসি এবং অন্যান্য ভারতীয় নৃত্যধারা চর্চা করেছেন, দেশে বিদেশে বিভিন্ন যায়গায় তার প্রদর্শনীও হয়েছে। কর্মশালাটি ছিল মোট তিন দিনের। কিন্তু সেই কর্মশালার অভিজ্ঞতা আমার কাছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস উন্মোচিত করে দিয়েছিল। নাটক, নাচ বা মূকাভিনয়ের জন্য নিজের শরীর প্রস্তুত করার বিভিন্ন চর্চার পাশাপাশি সেখানে আমাদের দিয়ে তিনি আরেকটি কাজ (খেলা) করান। খেলাটি ছিল এরকম: সমস্ত প্রতিযোগীরা একটি নির্দিষ্ট বদ্ধ এলাকায় প্রাথমিকভাবে ঘুরে বেরাবে কোনো নির্দিষ্ট সঞ্চারপথ ছাড়া, তারপর তারা তাদের কথোপকথন (যোগাযোগ) বা অপর প্রতিযোগীদের সাথে সম্বন্ধ নির্ণয় করবে কোনো রকম বাচিক ব্যবহার ছাড়া, অর্থাৎ আমার অপর কোনো প্রতিযোগীকে দেখে তার মনের ভাব অনুধাবন করে যা করতে ইচ্ছে করবে তাই করা যাবে বা তারও যা করার ইচ্ছে হবে সে করতে পারে। এবং এই সম্বন্ধটি গড়ে উঠবে সম্পূর্ণত প্রতিযোগীদের অঙ্গ সঞ্চালনার মাধ্যমে। এবং অপরের আচরণ বিধি আমার পছন্দ হচ্ছে না কি হচ্ছে না তাও সেই শরীরি ভাষাতেই তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। তো এর ফল স্বরূপ কেউ আমার চুলের মুঠি ধরে হিরহির করে যেমন টানল আবার তেমনই হাত দিয়ে আরেকজন চিনে নিল আমার ত্বকের ভাষা, কেউ চাইল কেবল অপলক দৃষ্টিতে দেখতে তো কেউ হেসে গড়িয়ে পরতে, কেউ এমন এক প্রতিযোগীকে খুঁজে পেল যে তাকেই নানাভাবে চেনার চেষ্টা করে গেল, আর অপর কোনো প্রতিযোগীর দিকে তার মনই গেলনা, তো কেউ সব প্রতিযোগীর সাথেই কোনো না কোনো রকম সংযোগস্থাপনের চেষ্টা করে গেল। যা ঘটল সম্পূর্ণ নির্বাক। এই খেলাটি ঠিক কতক্ষণ চলেছিল আমার মনে নেই। তবে আমি অনুভব করে ছিলাম আমি আমার সহপ্রতিযোগীদের অনেককেই ওই কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক খানি চিনে ফেলেছি বা বলা ভাল তাদের সাথে আমার যেন অনেক কথা হয়ে গেছে, হয়ত মুখের ভাষা ব্যবহার করলে ঐ সময়ের মধ্যে অত কথা বলাই যেত না। আর এটি কেবল আমার একার অনুভূতি নয় আরো অনেকেরই হয়েছিল তা আমরা সেই কর্মশালার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলার সময়ে জানতে পারি। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে শরীর কে একটা ভাষা হিসেবে অনুধাবনের জন্য তখন থেকেই নাড়া দিয়ে যায়।
তখন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র, গঠনবাদ, উত্তর গঠনবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব ইত্যাদি প্রভৃতি কঠিন কঠিন শব্দ এবং বিষয় নিয়ে নাড়া চাড়া করি এবং ক্রমাগত চেষ্টা করে যাই সেই বিষয়গুলি সহজ করে বোঝার। আমার থিয়েটার যাপন আমায় এই সাহিত্যের কাটাছেঁড়া করার কঠিন অস্ত্রগুলিকে সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছিল একথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। এবং সাহিত্যচর্চা আমার থিয়েটার শিক্ষাকে ততটাই অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। অর্থাৎ সেই সময় থিয়েটার যাপন এবং সাহিত্যচর্চা আমার কাছে একে অপরের পরিপূরকের ন্যায় কাজ করেছিল যা আজো বিদ্যমান। তখন কেবলই ভাবতাম যদি কোনোদিন সুযোগ পাই ভাষার গঠন বিজ্ঞানের সাথে মানব শরীরের একটি তুলনামূলক গবেষণা করব। যখন প্রথম ভেবেছিলাম তখন মনে হয়েছিল বিরাট কিছু নতুন ভেবে ফেলেছি, কিন্তু তারপর দেখলাম এই ভাবনায় মানুষ আদিমকাল থেকে ভাবিত হয়ে এসেছে, প্রাথমিক ভাবে সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মাধ্যমে, মানুষের বাক্ যন্ত্র ব্যবহারেরর অজ্ঞতাজনিত কারণে তাদের যোগাযোগ স্থাপনের মূল ভিত্তি হিসেবে, তারপর ক্রমাগত সেই শরীরিভাষাকেই বাচিক, রৈখিক এবং লিপি আকারে। তারপর বিভিন্ন বৈদিক, বৌদ্ধিক এবং অন্যান্য প্রাচীন বিশ্বাসলব্ধ আচার-উপাচারের মাধ্যমে, মানব শরীরকে বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় শ্রেণীবিন্যাসের ন্যায় কল্পনা করে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন- মস্তক ব্রাহ্মণের প্রতীক, ধর ক্ষত্রিয়ের, করতল এবং শরীরের মধ্যভাগ বৈশ্য এবং নিম্নাংশ শুদ্র, এবং সেই অনুসারে তাদের জ্ঞাতিগুষ্টির নামকরণ। এই প্রকার স্থুল বিভাজন ছাড়াও মোক্ষলাভ বা দৈব অনুসন্ধানে শরীরের বিভিন্ন প্রকার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যেমন- উপনিষদের আরণ্যক অংশে সন্ন্যাসীদের যে প্রকার সাধনচর্চার কথা বলা হয়েছে; বাহ্মণ্যধর্মের সত্যতাকে প্রশ্নের সম্মুক্ষিণ করে আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্ট পরবর্তী যুগে বহু সাধক আপন প্রক্রিয়ায় সেই অনুসন্ধান চালিয়ে যান বিদ্যমান ধর্মীয় আচারের বাইরে বেরিয়ে এসে। তারা কেউ আমৃত্যু অভুক্ত থেকে সেই অভিজ্ঞতা আত্মস্থ করেন, কেউ গাছে উল্টো হয়ে ঝুলে, কেউ ক্ষৌরকর্ম বন্ধ করে দিয়ে, কেউ সূর্যালোক পরিত্যাগের মাধ্যমে। এই প্রতিটি দৃষ্টান্তই আদপে একটি সংযোগ বা সম্বন্ধ নির্ণয়, তাবে তা প্রকৃতি বা আপন আপন আরাধ্য ঈশ্বরের সাথে বা অজানাকে জানার এবং তার সাথে যোগযোগ স্থাপনের ভাষার খোঁজও বলা যায় একে। এই ভাষার খুঁটিনাটি অনুসন্ধান অত্যন্ত কঠিন অভ্যাস সাপেক্ষ এবং তা আমার উদ্দিষ্ট ‘মনের ভাব প্রকাশ মাধ্যম’ বা ‘যোগাযোগের মাধ্যম’-এর থেকে খানিক ভিন্ন। আমি যে ভাষাটির খোঁজ করছি তা মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের ভাষা। যা ভরত মুনি সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের চর্চাযোগ্য পঞ্চম বেদ নাট্যশাস্ত্রে ব্যাখ্যা করেছেন (১)।
অবশ্যই তার ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ মানুষের দৈনিক কাজকর্মের বা চাষাবাদের কর্মনীতি বিষয়ক ছিল না, তা ভীষণ ভাবেই নির্দিষ্ট ছিল নাট্যকলা বিষয়ক শরীরি ব্যবহারের নিমিত্ত। ভরত মুনির বিশ্লেষণ চূড়ান্ত বিশদে রচিত, আমি এখানে তার সামান্য কিছু নামকরণ ব্যাতিত কিছুই করব না। নাট্যশাস্ত্রে উপাঙ্গবিধান অধ্যায়ে তিনি শরীর বিষয়ক আলোচনায় প্রবিষ্ট হচ্ছেন, চার প্রকার অভিনয়ের (আঙ্গিক, বাচিক, আহার্য এবং সাত্ত্বিক) প্রথম অংশ ‘আঙ্গিক’-এর বিস্তারিত আলোচনায়। আমি এখন তার বিস্তারিত উল্লেখ সেখান থেকে তুলে আবার লিখতে একেবারেই ইচ্ছুক নই, যদি কেউ আমার লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হন তাহলে নিজেরাই পরে নিতে পারেন। তবে এটুকু বলতে পারি সেখানে শরীরকে অনেকগুলি বিভাগ থেকে উপবিভাগে বিভাজনের মাধ্যমে এতটাই বিশদে আলোচনা করা হয়েছে যে তার কাছে বাংলা ভাষার ব্যাকরণের অধ্যায় সংখ্যা কম পরে যাবে। নান্দিকেশ্বর-এর অভিনয় দর্পণে-ও এই প্রকার বিশদ আলোচনা পাওয়া যায়। যেখানে প্রাথমিক ভাবে সম্ভাব্য মানুষের মনের ভাব কয় প্রকার এবং কি কি হতে পারে তার কথা বলা হয়েছে, এবং তারপর একটি (বা ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক) মানব শরীর কীভাবে তা প্রকাশ করবে তার বিস্তারিত বর্ণনা। তবে এই ভাষা ‘সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ’-এর সাথে মিলিয়ে দিলে কিন্তু চলবে না। কারণ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ-এর ক্ষেত্রে একটি মূল পার্থক্য হল, এই আঙ্গিক অভিনয়ে যে নিজের (বা চরিত্রের) মনের ভাব প্রকাশ করছে সেই ভাষার ব্যকরণ দর্শক বা যার কাছে ভাব প্রকাশ করা হচ্ছে তার জানাটা বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ হাতের মুদ্রা দেখেই বোঝা যায় হরিণ বোঝানো হচ্ছে না সিংহ, তার জন্য তাকে আগে থেকে কোন মুদ্রার কি অর্থ সেসব জানতে হয় না। কিন্তু সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের ক্ষেত্রে আর পাঁচটা মৌখিক ভাষার মতনই জানতে হয় তা ব্যবহার করার বা সেখান থেকে অর্থানুসন্ধানের প্রক্রিয়াটি। কেবলমাত্র আঙ্গিক অভিনয়-এর বলে নয়, যদি নৃত্যের কথাও বলা হয় তার জন্যেও কিন্তু যন্ত্রানুসঙ্গ বা কন্ঠসঙ্গীত বাধ্যতামূলক ছিল (আধুনিক ট্যাপ নৃত্যে যদিও নৃত্য শৈলী নিজেই নিজের শব্দ উৎপাদন করে নেয়)।
অর্থাৎ, বোঝাই যাচ্ছে আমি যে ভাষা নিয়ে এখানে আলোচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছি তার অনেকখানি কাজই ভরত এবং তৎপরবর্তী মুনিরাই করে দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমি এই ভাষাকে রঙ্গালয়ের আতিশয্য থেকেও যদি বের করে আনতে চাই, তাহলে আমাকেও এখন ‘এস্পারেন্তো’-র মতন একটি সার্বজনীন শরীরি ভাষা নির্মাণ করতে হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তো সেই নবনির্মিত ভাষা শিক্ষার দায় এবং একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া এবং তার দরুণ মাথার ঘাম পায়ে ফেলার ব্যর্থতার উর্ধ্বে যেতে পারে না। এইখানে সেই ভাষাকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় মূকাভিনয়। এখানে আমি আরেকটি কর্মশালার উল্লেখ করতে চাই যেটির আয়োজন করেছিল পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র (ইজেডসিসি) মূকাভিনয় এবং অঙ্গ সঞ্চালনা বিষয়ক। সেখানেও মোট ন’দিনে আমরা সান্নিধ্য লাভ করি শ্রদ্ধেয় মইনূল হক, ডঃ ইয়ুম্নাম সদানন্দ সিং এবং ন্যাশেনাল মাইম ইন্সটিটিউট-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নিরঞ্জন গোস্বামী বাবুর। মইনূল বাবু যে তিনদিন আমাদের কর্মশালা পরিচালনা করেন, সেই তিন দিনে যে পরিমাণ প্রাণ খুলে হেসেছিলাম তা বোধ হয় তার আগের গোটা তিনটে মাসে হাসিনি। রক্তমাংসের চার্লি চ্যাপলিনকে দেখছিলাম মনে হচ্ছিল। তিনি আমাদের কল্পনা এবং শরীরকে মেলাতে শিখিয়েছিলেন। অর্থাৎ একজন অভিনেতা তার শরীর যেমন প্রস্তুত করছে তেমনি তাকে তার কল্পনাকেও প্রস্তুত করতে হবে, আগে কল্পনা করতে হবে তারপর শরীরকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। মূকাভিনয় এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে কল্পনার অবারিত দ্বার। তিনি মাইমকে ম্যাজিকের সাথে তুলনা করেছিলেন। যে ম্যাজিকটা ঘটানোর একমাত্র উপাদান হল মানব শরীর। মইনুল বাবু আমাদের তাঁর অনেকগুলি ছোট ছোট উপস্থাপনা উপহার দেন কর্মশালার মধ্যেই, তার মধ্যে একটি গ্যাস-বেলুনওয়ালার গল্প, মন্দিরের গল্প, বক্সিং ম্যাচের গল্প, মাছ ধরার গল্প ছিল যা সারাজীবনেও ভুলতে পারবনা, গল্প গুলো খুব সরল, কিন্তু তার কল্পনায় সেগুলি ম্যাজিক হয়ে উঠছিল। তিনি অভিনয় করাকালীন দর্শকদের প্রতিক্রিয়াতেও মন দেন এবং সেখান থেকেই তিনি বুঝতে পারেন তার কল্প জগত দর্শকদের কাছে তিনি কতখানি ফুটিয়ে তুলতে পারলেন। ইউটিউওবে তার কিছু কাজের নিদর্শন পাওয়া যায়, আগ্রহীরা একবার চোখের দেখা দেখে নিতে পারেন, তবে সরাসরি দেখার মধ্যে যে তরঙ্গবিস্তার পায় তা ইউটিউব দিতে পারবে না এ আমি আগেই বলে রাখলাম। উনি আমাদের টেকনিক যেমন শিখিয়েছিলেন তেমনি শিখিয়েছিলেন একটি সার্বিক গল্প বলার পদ্ধতি, উনি বলেছিলেন ‘যে গল্পটা বলতে চাও তার শুরু আর শেষটা আগে ভেবে নাও, তারপর তার মধ্যে মনোরঞ্জক মশলা দিতে থাকো, তোমার উপস্থাপনা তৈরী হয়ে যাবে’। তার শরীর যে ভাষায় কথা বলতে পারে তা দেশ-কাল সীমা অতিক্রম করে যে কোনো মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে এবং পৌঁছেও গেছে, গৌহাটিতে তার হাতে ভবিষ্যতের বহু মাইম শিল্পী প্রতিনিয়ত তৈরী হয়ে চলেছে। এর পর আসি মণিপুরের আরেক যাদুকর ডঃ ইয়ুম্নাম সদানন্দ সিং-এর কথায়, তিনি একজন প্রসিদ্ধ নাট্য পরিচালক। আমাদের দূর্ভাগ্য আমরা ওনার প্রযোজনা কলকাতায় বসে দেখার সুযোগ পাই না। উনি আমাদের মণিপুরি মার্শাল আর্ট-এর মাধ্যমে শরীর প্রস্তুতির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং শরীরকে চিনতে শিখিয়েছিলেন। ওনার প্রযোজনা মাইমের চিরাচরিত কালো পোশাক এবং সাদা মেক আপে আবদ্ধ নয়। ওনার প্রযোজনায় একটি বাণিজ্যিক উপস্থাপনার মতই পোশাক, প্রসাধনী, মঞ্চ, আবহ, উপাদান সবই থাকে, কেবল বাচিক ভাষার ব্যবহার থাকে না, সম্ভবত প্রয়োজন পরে না, শরীর বচনের থেকেও অধিক কথা বলে তার প্রযোজনায়। মণিপুরের রাজনৈতিক অবস্থার উপর ওনার একটি নাটক উনি আমাদের দেখান (প্রোজেক্টারের মাধ্যমে), যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র ইরম শর্মিলা চানুর আত্মা, সেখানে একটি শ্লীলতাহানির দৃশ্য তিনি নির্মাণ করেন যেখানে তিনজন সেনা একটি মেয়ের শ্লীলতাহানি করে, এই দৃশ্য নির্মাণে মেয়েটি মঞ্চের উপর শুয়ে থাকে এবং বাকি তিনজন তাকে ঘিরে এক তান্ডব নৃত্য চালায়, কিন্তু মেয়েটিকে একফোঁটাও স্পর্শ করে না, তৎসত্ত্বেও দর্শক এই ঘটনার বীভৎসতাকে হাড়ে মজ্জায় অনুভব করতে পারে, কেবল শরীরের ভাষা অনুসরণ করে। মইনূল বাবু যেমন একজন মানুষের ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন, সদানন্দ জি তেমনি বহু মানুষের মাধ্যমে শরীরি ভাষায় ব্যাপকতার পরিচয় ঘটান, এবং নিরঞ্জন বাবু আমাদের মূলত যেটি শিখিয়েছিলেন তা হল নাট্যশাস্ত্রে-র রসসমূহের আঙ্গিক বহিঃপ্রকাশ। যে বিষয়ে লেখার শুরুতেই কথা বলেছি, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ বলা যায়।
এবার ধিরে ধিরে বিষয়টি গোছানোর দিকে যাব, এবং বর্তমানে বাংলা থিয়েটারে এই ভাষার প্রয়োগের কিছু দৃষ্টান্ত দিয়ে আমার বক্তব্য শেষ করব। মূকাভিনয় আমার কাঙ্ক্ষিত ভাষার সবচেয়ে কাছাকাছি হলেও সেটিই অন্তিম পর্যায় নয়। কারণ আমার ইচ্ছেটা হল, ধরুন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষাভাষির দুটি মানুষের কোনো একটি সেমিনারে দেখা হল, তাদের মধ্যে যদি কোনো সাধারণ যোগাযোগের ভাষা নাও থাকে তারা যাতে এই শরীরি ভাষায় দীর্ঘক্ষণ কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে। আফ্রিকা বা ভারতবর্ষে খ্রীষ্টান মিশনারিরা নিজেদের বিস্তার ঘটাবার সময়ে বহুক্ষেত্রে তাদের এরকম বিপদে পড়তে হয়েছিল যে, যাদের কাছে তারা এসেছে তারা ইংরেজি জানে না, আবার তাদের লোকায়ত ভাষাকেও আয়ত্ত করার কোনো উপায় নেই, তখন তারাও কিন্তু সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়ের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছিল নিজেদের ব্যক্ত করার জন্য। আর আজকের গুগল ট্রান্সলেটার-এর যুগে চ্যাট করার ক্ষেত্রে হয়ত জয়নগরের ছেলে জার্মানির মেয়েকে সহজেই পটিয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু মুখোমুখো হলেই তো সব শেষ। কাজেই শরীরকে উপেক্ষা করার কোনো জায়গাই নেই। আমি এই ক্ষুদ্র পরিসরের আলোচনায় শরীরের আরো অনেক বিস্তারের কথাই উল্লেখ না করে গেলাম, যেমন এই বিষয়টির প্রতি বিদেশী ভাষাবিদ, তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, তারপর শরীরের যৌনবৃত্তির যোগাযোগ বা কথোপকথন মাধ্যম, শরীর চর্চা পদ্ধতি, বাচিক থেকে আঙ্গিক বা আঙ্গিক থেকে বাচিক ভাষার অনুবাদের পদ্ধতি ইত্যাদি। আমি এই একটি রচনাতেই আসলে থেমে যেতে চাই না, এই বিষয় লেখালিখি এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ চলতে থাকবে, সেখানে এই সবের সাথে আরো অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হবে। আমি ‘সাত তলা বাড়ির’ বাসিন্দাদের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ তারা আমার ভাবনা কে সম্মান জানানোর জন্য, আমরা বন্ধুবান্ধবরা একসাথে মিলে প্রায় দু মাস ধরে একনাগাড়ে এই ভাষাটির চর্চা করে যেতে পেরেছি, তারা আমায় প্রচুর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে এই অনুসন্ধানে, যার ফল স্বরূপ আমরা আমিরা নামক একটি প্রযোজনাও তৈরী করতে পেরেছি, যেখানে বাচিক ব্যবহার ছাড়াও মানুষের মনকে আমরা ন’টি মানব শরীর দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছি। যদি কেউ এই বিষয়ে আগ্রহী হন, তাদের আভিজ্ঞতা আমার এই বিষয়টিকে ঋদ্ধ করে তবে অবশ্যই জানাবেন কারণ আমি এই বিষয়টি নিয়ে আরো গভীর চর্চা করতে চাই।
উপসংহারে আমি এই ভাষা প্রয়োগের কিছু উদাহরণ দিতে চাই, যার কথা সবার প্রথম আমার মাথায় আসে তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় গৌতম হালদার মহাশয় এবং তার মেঘনাদ বধ কাব্য নাট্য প্রযোজনাটি। সঙ্গীতশিল্পীদের সাহচর্যে তার একক অভিনয় দেখে আমি বহু মানুষকে বলতে শুনেছি, ‘বাপরে বাপ এতটা মনে রাখেন কি করে?!’ আর উনি যে একটি মাত্র উত্তরীয় ব্যবহার করে এতগুলি চরিত্র সেজে উঠলেন, এত গুলি আত্মাকে নিজের শরীরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললেন সে কথা খুব কম মানুষই আলোচনা করেন। ওনার অসামান্য বাচিক অভিনয় আমরা যদি একটা অডিও ফাইল হিসেবে কেবল শ্রবণ ইন্দ্রীয়ের মাধ্যমে উপভোগ করি তাহলে যেমন আমরা ঋদ্ধ হব আমার মনে হয় ঠিক তেমনই আমরা যদি তার অভিনয় বধিরের ন্যায় কেবল চোখ দিয়ে অনুভব করি তাহলেও সমান গায়ে কাঁটা দিয়ে যাবে। এটি অনেক পুরনো প্রযোজনা এই নিয়ে বহু লেখালিখি হয়েছে তাই আমার বিষয় হিসেবে এর থেকে বেশি আর কিছু বললাম না। মনীশ মিত্রের 'ঊরূভঙ্গম' নাটকে প্রধান কথকের নারী চরিত্রের রূপদান শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনেই সফল এবং যথাযথ। একুশ শতকের জনপ্রিয়তম চলতি প্রযোজনা ‘বুকঝিম এক ভালবাসা’-য় শ্রমণ চ্যাটার্জির শরীরের ভাষার উল্লেখও করা যায়, ধরা যাক যেখানে চাঁদ সুলতানার সাথে বিবি নুরজাহান-এর কথোপথন হচ্ছে, অভিনেতা কিন্তু কন্ঠে মারাত্মক কোনো বিকৃতি না এনেও পাশাপাশি বসে থাকা দুটি নারী শরীর কে একই দৃশ্যে স্থান দিয়েছেন। আসলে এই ভাবে উল্লেখ করতে থাকলে এই লেখা শেষ নাও হতে পারে এবং এরম মনে হতেই পারে ‘বারে এর নাম বললে আর এর নাম বললে না!’ হ্যাঁ সত্যিই দেবশংকর হালদার মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বোঝা যায় তিনি এসেছেন, তবু তার কথা বললাম না বা এই সময়ের তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত যার প্রেমে পরে চলেছে সেই অনির্বাণ ভট্টাচার্য্য কি শরীর নিয়ে ভাবেন নি! অবশ্যই ভেবেছেন এবং চর্চা করে চলেছেন, কিন্তু উল্লেখ করতে থাকলে তারা বারবার ফিরে আসবেন বাধ্যতামূলক ভাবেই, আমি কেবল আমার বক্তব্য বোঝানোর জন্য কয়েকটি জনপ্রিয় উদাহরণ দিলাম বলা যায়। আমার উল্লেখে কেউ ক্ষুণ্ণ হলে নিজগুণে আমায় ক্ষমা করে দেবেন। তো ব্যক্তি বিশেষের নামে এখানেই ইতি টানলাম। এবার আসি রসিকতা নাট্যদলের ‘ফলসি চড়ার উপাখ্যান’ নাটকটির বিষয়ে, এতক্ষণ যেমন একজন মানুষের উল্লেখ করলাম এই প্রযোজনাটিতে এই শরীরের ভাষার ব্যবহারিক প্রয়োগ এক দল মানুষের মধ্যে দিয়ে দেখা যায়, তারাই কখনও পুকুর, কখনও বাড়ি, কখনও বাঘ, কখনো কথক, কখনও গাছ হয়ে উঠছে, এবং একেকটি অসামান্য দৃশ্য নির্মাণ করে চলেছে। এই নাটকের শেষ দৃশ্যে ব্রাজিলের নাট্য ব্যাক্তিত্ব অগাস্তো বোয়ালের ‘ইমেজ থিয়েটার’-এর ব্যবহারও দেখা যায়। যার সম্বন্ধ্যে আমরা পরে কোন একটি রচনায় বিস্তারিত আলোচনা করব। দলগত শরীরী ভাষার পরিচয় আমরা এর আগে উড়িষ্যার সুবোধ পট্টনায়ক, মণিপুরের রথন থিয়ম, মধ্যমগ্রামের অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটার-এর বিভিন্ন কাজে বারে বারে দেখতে পাই।
আগের অংশটিতে আমি মঞ্চ প্রয়োগের মধ্যেই সীমায়িত করলাম নিজেকে, কিন্তু আমার ইচ্ছে আরো বিস্তৃত। এবং সেই বিস্তার আমি একা ঘটাতে পারব না, তাই সকলের কাছে অনুরোধ রইল এই রচনা যদি আপনাদের একটুও ভাবিত করে তাহলে হয় আমার সাথে যোগাযোগ করে একসাথে বা নিজেরা নিজেদের মতন করেও চর্চা করে যেতে পারেন, কিন্তু শরীর কে অবহেলা করবেন না, ওই ভাষাটা আমরা নিয়েই জন্মাই, কেবল চিনতে শেখাটুকু আমাদের কাজ।
ঋণ
(১)ভরত নাট্যশাস্ত্র, নবপত্র প্রকাশন, সম্পাদনা ডঃ সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
মন্তব্যসমূহ