দীপ রায়

এরড্রোমের সংস্পর্শে


(১) ৫নং মোর্চা গেট

৫নং মোর্চা গেটের বাইরে সর্বক্ষণ দ্যাখা যায়
  কয়েকটা অচেনা ও অনঅভ্যস্ত মুখ
সেই যে সামনে ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোহাপ্রহরী
সুইচের চাপে যার চোয়াল খুলে যায় প্রতিনিয়ত
আর হাঁয়ের ভিতর দিয়ে ঘটে চলে বিকন লাগালো ধীরগতিময় চলাচল
যার ঠিক ঠোঁটের বা-কোণে সদা অপেক্ষারত একটা নিমগ্ন ফ্রিস্কিং বুথ আর দু-জন উর্দিধারী, কাঁধে বন্দুক
আর ডান কানের দিকে একটা জাগ্রত ওয়াচ-টাওয়ার, কব্জির ফাঁকে ধরা বাইনোকুলার
তার চিবুক বরাবরই ছড়িয়ে থাকে এই ইতিউতি জটলা

ওঁরা কোথা থেকে আসে আমার জানা হয়নি কখনো
কারো এক কাঁধে ব্যাগ অন্য হাতে শিশু
কেউ বা মোবাইল ক্যামেরা হাতে পুষে চলে আকন্ঠ জোনাকিপ্রীতি,
যদি বেড়ালের ভাগ্যে সিকে ছেঁড়ে
যদি একবার ওই ধারালো মাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসা "ভাগো ইহাসে" অথবা "নিকলো ইহাসে" মেঘডাকের মাঝে ঘটে যায় এক মোক্ষম বজ্রপাত
গায়ে লেপ্টে থাকা অবজ্ঞাচাদর সরিয়ে একবারটি যদি ওই বিরল ডানাজোড়ার হাতছানি মেলে
যাকে স্বচক্ষে দ্যাখা হয়ে ওঠেনি কোনোদিন
যার রাশভারী নামটি কোলের শিশুটি আদো গলায় রোজ সন্ধেতে পড়ে, এ ফর এরোপ্লেন...


(২) নোটাম

ধরা যাক একটা বিশাল বাগানবাড়ির নির্দিষ্ট কয়েকটা ঘর আপনার জন্য খুলে দেওয়া হবে
সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে আপনি পরিবার-পরিজনকে সঙ্গে নিয়ে অথবা একাই এসে থেকে যাবেন কিছুদিন
কিংবা কয়েক ঘন্টাই স্থায়ী হবে সেই অভিজ্ঞতার টাইমলাইন।
আপনি টিভি দেখবেন, গান শুনবেন, ছবি আঁকবেন অথবা অট্টহাসিতে মেতে উঠবেন,
যাই হোক না কেন কেউ আপনাকে একবারটিও বিরক্ত করবেনা
যদি না ভুল করে ওই বাড়িটিতে থাকাকালীন চৌকাঠ ডিঙিয়ে আপনি অন্য ঘরে ঢুকে যান
যদি না সময় পেরিয়ে গেলেও ঘরের ভিতর থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে হন অপারগ...
ওই দু-একটি অনুমুতিপ্রাপ্ত ঘরেই আপনার স্নায়ু সদা সজাগ থাকাই শ্রেয়,
আপনার পাশ্ববর্তী অবস্থানগুলো যতই রঙিন হোক না কেন; 
প্রবেশের আগে তাদের দুর্বোধ্য ভাবতে শেখা জরুরি
অগত্যা জরিমানা নিশ্চিত, অযথা ঝক্কি পোওয়ানো

এয়ারসাইডে রোজ ঠিক এমন ভাবেই ছেড়ে রাখা হয় কিছু টুকরো জমি
পাঁচিলহীন, দেওয়ালহীন অথচ অদৃশ্য শিকলের আঁচড়ে আবদ্ধ 
যেখানে কাজ করা একান্তই সময়সাপেক্ষ
যাকে বাস্তবে রূপ দিতে অবধারিত রাখা কয়েকটা লাল-সাদা ফ্ল্যাগ ও রেডিয়াম স্ট্রাইপ লাগানো প্লাস্টিককোণ...

(৩) যাঁদের থাকে পরিযায়ী সংসার

এক ঝলক দেখলে মনে হয় হলদে শালিক
কখনো বা কাছ থেকে লাগে লালঠোঁটের টিয়া
ওঁরা উড়ে চলে প্রতিদিন, সারা মাস
দেখতে পাই ওঁদের টার্মিনাল সংলগ্ন রাস্তায়,
 দিনে-রাতে লাগেজ-হাতে হেঁটে যাওয়ার সময়।
ওঁরা কেউ কাচ তুলে ক্যাবে হয় সওয়ারী
কেউ বা গোপালের ক্যান্টিনে বসে নিশ্চিন্তে করে ধূমপান
ওঁরা পা মেপে মেপে এগিয়ে চলে, সর্বদা হাসিমুখ
অলিখিত কোট-আনকোট "ডি জব ডিমান্ডস!"

ওঁদের সাথে আলাপের সুযোগ ঘটেনি সেরকম
জানা হয়ে ওঠেনি কখনো
 ওঁরা বাস্তুবে কতটা, আদৌ কী কিছু ক্ষোভ পোষে
খালি মাঝেমধ্যে টের পাই খবরের শিরোনামে
আঁটোসাঁটো মোড়কের ভিতর করুণ ছন্দপতন
ওঁদেরও শ্রাবণ থাকে, চোরাস্রোত থাকে...

(৪) এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ার

দেওয়া হয় পথনির্দেশ, অনেকটা যেমন
একজন মানুষ প্রথমবার যাবেন কোনো অপরিচিত ঠিকানায়
কোন গলি ছেড়ে আর কতটা তাঁকে এগোতে হবে 
কোন দোকানের পাশ দিয়ে আর দশ মিনিটের হাঁটা
ঠিক একইভাবে এখানেও জারি থাকে বার্তাপ্রদান, যতক্ষণ না উক্ত ব্যক্তিটি দোরগোড়ায় পৌঁছয়...

যদিও এখানে বেশিরভাগ পথচারীদের এলাকাটি হাতের তালুতে,
যদিও তাঁদের অনেকেরই জলভাত এই পাড়ার হালহাকিকত,
তবু নিয়মের বেড়াজালে অতিপ্রাসঙ্গিক এসব নির্দেশনামা
যেহেতু এই পথচারীদের হাতেই সদা নির্ভরশীল অসংখ্য প্রাণ...

তাকে জানানো হয় সচল আছে কোন রাস্তাটি
কোন গলি দিয়ে স্বচ্ছন্দে পৌঁছে যাবে সে
তাকে বলা হয় দরকারী তথ্য আরও যা
যেমন আবহাওয়া, বাতাসের গতিবেগ 

তবে পৌঁছে দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হওয়া নয়
তাঁর ফিরে যাওয়াতাও
 একইভাবে সুনিশ্চিত করা হয়
প্রসঙ্গত এই ঠান্ডাঘরই কেন্দ্রস্থল
 যেখান থেকে প্রতি মুহূর্তে চলে বার্তাপ্লাবন
সর্বোপরি এই যাতায়াতই উপলক্ষ্য
যাকে কেন্দ্র করে মাথা তুলে দাঁড়ায়
এই অঞ্চলের পারিপার্শ্বিক সমস্ত আয়োজন...

(৫) গোপালের ক্যান্টিন

এখানে আলো জ্বলে সারারাত
সসপ্যানে চায়ের জল শুকোয়না কখনো
সারি দিয়ে সাজানো থাকে চেয়ার ও টেবিল
থালা হাতে যা দখল হয় অহরহ
এখানে একটা ছোট টিভি চলে সবসময়
এই গত সপ্তাহে যা থেকে খেতে খেতে শুনলাম শাহানা বাজপেয়ীর সাম্প্রতিক দিজেন্ত্রগীতি
এখানে ভীড়ে মিশে থাকে কয়েকটা মানুষ
খাওয়া শেষে হাত ধুতে এগোলেই
 যাঁরা নিমেষে টেবিল সাফ করে দ্যান

যদি খোঁজ থাকে সুখ টান, খোঁজ থাকে ঠান্ডা পানীয়
কিংবা ধরা যাক ভাত-রুটি-পরোটা ছেড়ে চাইনিজ অথবা সাউথ-ইন্ডিয়ান, সবই মেলে এক মুহূর্তে
এখানে আমি মাঝেমধ্যে খেতে যাই রাতে,
কখনো বা সঙ্গ দিতে বসে থাকি কিছুক্ষণ
এখানে ক্লান্তিহীন কথাপাখি ডানা ঝাপটে চলে
যার স্বর ভেসে এসে জ্বালায় নিবিড় খড়কুটো

শুধু নয় অনুভব, শুধু নয় দেখে চলা কলরব
কখনো বা জ্ঞানত টেরই পাইনা এক একটি গ্রাস মুখে তুলে নেওয়ার ফাঁকে
 নিজেও কখন শরিক হয়ে উঠি
আসলে ভরা থালার সম্মুখে এক একটি তারাভর্তি আকাশের সন্ধান মেলে এখানে
আর প্রত্যেকেই মেতে ওঠে অনর্গল, শব্দচলাচলে...

টার্মিনালে হেঁটে যাওয়ার সময় রাস্তার ডানদিকে অবস্থিত গোপালের ক্যান্টিনে
কখনো কোনো তোড়জোড় থাকেনা
 নাকেমুখে পুরে চেয়ার ছেড়ে দেওয়ার...

(৬) কফি মাগ ও ঘাস চাদর

কাচের দরজা পেরিয়ে গুটিপায়ে
  বেরিয়ে আসে একেকটি ট্রলিব্যাগ
তুমি সেই চাকার মৃদু শব্দে মিশিয়ে দাও নিজেকে
মনে করো তোমার গলাতেই যেন আটকানো আছে
 এয়ারলাইনসের ওই টুকরো ট্যাগটি,
 গলা চ্যাটচ্যাট করে বুঝতে পারো;
 চামড়ার নীচে অনুভব করো অস্থায়ী লাল দাগ, 
আর তারপর ধুলো ডিঙিয়ে স্বচ্ছন্দে ঢুকে যাও সবেমাত্র লাইনচ্যুত হওয়া ক্যাবের ডিকিতে,
অথবা বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষারত
 কোনো এসি বাসের কর্নার সিটে...

তোমার কী মনখারাপ হয় লাল রং?
তোমার কী ঘরে ফেরার আনন্দ নেভি ব্ল্যু?
নাকি এসব আপাত বিচ্ছিন্নতায়
সুখ-দুঃখের কিনারে তল হারিয়ে ফ্যালা
 ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে,
আর তাই বিড়বিড় করে নিজেকে নিজেই বলো,
মনে রেখো মন, তুমি শুধুই পরিযায়ী সংকল্প,
কাটাতে এসেছো এখানে কয়েক মুহূর্ত, কিছুক্ষণ...
 দ্রুত হাতের কফিটি শেষ করো,
 কথা বলো পাশের বন্ধুটির সাথে
অথবা এই যে বসে আছো সিমেন্টের চাতালে
হাতে সময়ে থাকলে তার সামনে থেকেই
শুধু উপভোগ করার চেষ্টা করো দু-চোখের সামনে বর্তমানে খেলে যাওয়া জীবন্ত সমস্ত ফ্রেম।
নেমে এসো আকাশকুসুম, নেমে এসো অলীক...

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা