কিছুটা প্রলাপের মতো | তথাগত ঘোষ-এর গদ্য | আঙ্গিক


ব্বাস কিয়ারোস্তামির ‘টেস্ট অফ চেরি’ (১৯৯৭)-তে এক বৃদ্ধ ট্যাক্সিডার্মিস্ট ছবির প্রোটাগোনিস্ট-কে বলেন, কীভাবে একটি ফল তাঁকে আত্মহত্যা করা থেকে বাঁচিয়েছিল। বর্ণনা দেন এমন এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের, যা আমাদের মুখ্য চরিত্রকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর ধাক্কা দেয় আমাদেরও। হঠাৎ এই লেখাটা লিখতে বসে বারবার ওই কথাগুলোই কানে বাজছিল। আসলে কেন জানি না নিজেকে ওই প্রধান চরিত্রের মধ্যে সাংঘাতিকভাবে দেখতে পাই। প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে এই প্যান্ডেমিক শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে অনেক খারাপ চিন্তা মাথায় ভিড় করেছে। মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছি নানাভাবে। তখনই কানে বেজে উঠেছে ‘টেস্ট অফ চেরি’র ওই সংলাপগুলো। হয়তো সুনীল ঠিকই বলেছেন, “আহ! বেঁচে থাকা কী সুন্দর!”


সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। সিনেমা বানাতেও। তবে আজকাল সিনেমা বানানোর থেকেও বেশি ভাবি যে কেন একটা সিনেমা বানাবো। কী লাভ বানিয়ে! এতো সিনেমা তো সবাই বানাচ্ছে। ভালো কাজও হচ্ছে। তাহলে আমি আরেকটা সিনেমা বানালে কী আর আসবে যাবে! তাই গত এক বছর অনেকটা পাল্টেছি আমি নিজে এবং সেই পরিবর্তন এখনও ঘটে চলেছে। নিজে জানি। বুঝতে পারি। আর এটার সঙ্গে ওপরের কথাগুলোর এক নিবিড় যোগাযোগ আছে। কারণ ছবি বানানো আর বেঁচে থাকার ব্যাপারটা আরও আমার কাছে এখন কমপ্লিমেন্টারি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেখানেই প্রশ্নগুলোর উত্তরের আভাস পেয়েছি— “পার্সোনাল ছবি”।

হুগলি জেলার এক গ্রাম, ছবিঃ তথাগত

আর উত্তরটা আরও পরিষ্কার হয়েছে গত বছর আমার গ্রামে যাওয়ার পর। নিজের ছোটোবেলার অনেকটা কেটেছে আমার এখানে। বাবার সঙ্গে অনেকবার হাত ধরে গেছি ওখানে। তখন অবশ্য পৃথিবীটাই আলাদা ছিল। অন্তত আমার পৃথিবীটা। হোক না সেটা ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ক্যাপ্টেন স্পার্কের ঘরটার মতো ছোটো। ক্ষতি নেই। আসলে তাতে অধিকার ছিল একমাত্র আমার। তবে সেই ছোটো থেকেই যেন গ্রামটাকেই নিজের পৃথিবী মনে করতাম। ছবি আঁকার নেশা ছিল। ড্রয়িং বুক আর প্যাস্টেলের সেটটা সবসময় সঙ্গে থাকতো। গ্রামে গিয়ে নদীর ধারে বসে স্কেচ করতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত। ঠিক সেই রুকুর মতো।

মিস ম্যান, পরিচালকঃ তথাগত

গতবার পুজোর সময় গ্রামে গিয়ে ফের বসলাম নদীর ধারে। এখানেই আমার দুটো ছোটো ছবির শ্যুটিং করেছি আমি। একটি ‘মিস ম্যান’ ও আরেকটি ‘ধুলো’। তাই এখন আমার সঙ্গে আমার গ্রামের সমীকরণটা কিছুটা হলেও হয়তো পাল্টেছে। ওই যে বলে না, “কোনো কাছের মানুষের সাথে কাজ করলে তার সাথে সম্পর্কটা একটু হলেও বদলায়।” এক্ষেত্রেও হয়তো ব্যাপারটা তাই। বরাবর আমার গ্রামকে একজন মানব রূপেই আহরণ করেছি। ‘অযান্ত্রিক’-এ যেরকম বিমলের সঙ্গে জগদ্দলের সম্পর্ক ছিল। অনেকটা সেরম। মাঝেমাঝেই মনে হয়েছে যে গ্রামের প্রতি আমার টানটা এতটা কেন। সেটা কি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য? এঁকেবেঁকে চলা নদীর ওই মনকেমন করা এক অদ্ভুত শব্দের জন্য? নাকি নদীর পারে গাছটার ডালে বসা পাখিটার কিচিরমিচিরের জন্য? এগুলো কারণ ঠিকই। কিন্তু যত বড়ো হয়েছি, বুঝেছি যে আসল কারণটা অন্য— ওখানকার মানুষজন।

ধুলো, পরিচালকঃ তথাগত

মানুষের মুখ আসলে আমাকে বড়োই টানে। প্রকৃতির সব ল্যান্ডস্কেপ যেন আমাদের সবার মুখের মধ্যে লুকনো আছে। সময়ে সময়ে তা প্রকাশ পায়। সূক্ষ হোক বা মোটা দাগ, রাগ হোক বা অভিমান, হাসি হোক বা কান্না— সবটাই যেন প্রকৃতির প্রতিফলন। মানুষ জীবটি আসলে এক নিটোল সহজ সরলতা মাখানো আশ্চর্য ভাব প্রকাশ সৃষ্টিকর্তার। ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে অভিনেতাদের ক্লোজ-আপ ধরলে যেন সেটাই আরও প্রকটভাবে অনুভব করি। তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তার সেই দিগন্ত প্রসারিত পাঠশালায় বারবার ছুটে যাই মুখগুলোর সন্ধানে। বুঝতে পারি যে আসলে সব গল্পই একভাবে যেন গ্রামের গল্প। গ্রাম ভেঙেই তো শহরের সৃষ্টি। শহরটা আসলে আমাদের ঔদ্ধত্যের প্রকাশ।

মানুষগুলোর জীবন যতটা পারি আহরণ করার চেষ্টা করি। ফিরে আসি শহরে। নিজের ঘরে ঢুকে আয়নায় তাকাই। চোখের জায়গায় দেখি পাখির কোটর। নাকের জায়গায় দেখি কুলকুল করে ভেসে যাওয়া নদী। ঠোঁটের জায়গায় দেখি ধানক্ষেত। কপাল আর চুলের জায়গায় দেখি এক নাম না জানা গাছ ডালপালা বিস্তার করে গজিয়ে উঠছে। তৎক্ষণাৎ চিৎকার করে উঠি, ‘অ্যাকশন!’

মন্তব্যসমূহ

নামহীন বলেছেন…
বড় ভালো লেখা!! আগেকার নির্মাতাদের এভাবে বলার সুযোগ থাকতো না।
তথাগত গদ্যটি বেশ!
দেবাঞ্জন দাস বলেছেন…
আন্তরিক লেখা--ভালো লেখা। তথাগত'র ছবি দেখার ইচ্ছা হচ্ছে।

জনপ্রিয় লেখা