সুরের উড়ান | রাণা রায়চৌধুরী’র গদ্য | আঙ্গিক


ড়াল। আড়ালে থাকা মানুষ, বা অন্যান্য প্রাণীদের সম্পর্কে আমার কৌতূহল অনেকটা গুনগুনে গানের মতো আলোর শিখার মতো ভিতরে বাজে।

পাখির পালকের নিচে যে বালিকা গান শেখে, রেওয়াজ করে রোজ, তা আমি টের পেয়েছি একদিন ভোরে। পাখির পালকের নিচটা একটা গোপন সাধনার জায়গা। পাখি জানে শুধু তার শরীরে, পালকের নিচে একটা বাচ্চা মেয়ে হারমোনিয়ামে রেওয়াজ করছে। পাখি এ ডাল ও ডাল, এ আকাশ ও আকাশে যাচ্ছে ওই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে, তার হারমোনিয়াম নিয়ে, আর তার সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে। 

আমি এই আড়ালটাকে খুঁজি, কোন আড়াল থেকে বাচ্চা মেয়ের গান ভেসে আসে গো? তন্নতন্ন করে খুঁজি সারা জগৎ-সংসার, খুঁজি সেই আড়ালের ভিতরের আড়ালকে, পাই না। কিন্তু কানে গান ভেসে আসে। জগতের আনন্দযজ্ঞে কেউ গাইছে আড়ালে সর্বক্ষণ।

পাখি মেয়েটির সব সুন্দরকে পালকে গুঁজে নিয়ে যাচ্ছে কোনো অসুন্দর সংসারে, পাখি সেখানে সুন্দরের আলো জ্বালবে, আড়ালের আলো জ্বালবে – আড়াল দিয়ে আড়াল জ্বালবে।

তুমি মনে মনে যে প্রতিশোধের কথা ভাবছ গোপন-ঈর্ষায় সেও এক আড়ালের প্রস্তুতি। বদলা প্রতিহিংসার যে প্রদীপ তুমি জ্বালছ সেও আড়ালের কুয়াশাধ্বনি ... কেউ না কেউ টের পাচ্ছে – দেখতে পাচ্ছে - তোমার এই আড়াল-ব্যর্থতার চারাগাছকে। তুমি কষ্ট পাচ্ছ। গোপন প্রতিশোধের ইচ্ছা তোমার সুন্দর শুভ্র আড়ালকে কষ্ট দিচ্ছে। অথচ তুমি চেয়েছিলে তোমার একার আড়াল দিয়ে আরো অনেক না-ফোটা সুন্দরকে তুমি সুর দেবে – দেবে স্রোতের বহতা। তোমার একটা শিশুমন আছে – জানে তা সকলে – কিন্তু তোমার শিশুমনের সুর তাল কাটছে কোথাও ...এসো জলের কাছে যাই ...এসো আড়ালের ভিতরের যে আড়াল সেখানে যে গভীর তানপুরা আছে এস্রাজ আছে - চলো তাকে বাজাই ...ভালোবাসাকে বাজাই...   

বক উড়ে যায় তার সব সাদা নিয়ে প্রকাশ্যে, কিন্তু আড়ালে রয়েছে তার ভিতরের কিরণ। তার সৌন্দর্য। লোভী শিকারী তার সেই ভিতরের সৌন্দর্যকে টের পায় না। বকের এই সৌন্দর্য একমাত্র দেখতে পায় আকাশ আর দেখতে পায় বাতাস। আকাশের বাতাসের কোনও লোভ নেই। তাই হিংসা বা ঈর্ষা বা প্রতিশোধস্পৃহা নেই। বকপাখি কোনোদিন কোনও অন্যায় করেনি। মিথ্যা বলেনি। সে শুধু আপন ধর্ম পালন করে গেছে। আপন ধর্ম পালনই তার আড়ালের সাধনা। আড়ালের চিরসত্য। বকের আড়ালউড়ানে ‘আমি’ নেই, অন্ধকার নেই, আছে শুধু সামনে এগনো... 

আমাদের সামনে সবসময়ই এক অপার সৌন্দর্য অপেক্ষা করে আছে আড়ালে। কিন্তু আমাদের ধৈর্য নেই অপেক্ষার, তাই দ্রুত আমরা প্রকাশ্যে আসি। নিজেকে দেখাই। কিন্তু আড়ালের আড়ালে অপেক্ষা করেছিল অগভীর সমুদ্রের মতো বিশাল এক সুন্দর ও সুন্দরের তৈরি আড়াল। 

বনজ ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকার এক আয়োজন, আর বিবেকের আড়ালে লুকিয়ে থাকার আরেক আয়োজন। জ্ঞানের আড়ালে থাকাও আলোর আড়ালের আলো। 

বনজ ঝোপের আড়ালে যে লুকিয়ে আছে সেও নিষ্পাপ হতে পারে, লোভহীন ক্রোধহীন হতে পারে সে। শুধুমাত্র জৈবিক ক্ষুধার কারণে শিকারের সন্ধানে তার আড়ালে থাকাটুকু, সেও এক যাপনের নিত্য যাত্রা। তাতে খিদে উপশমের নিত্য-সাধনা বা লড়াই লুকিয়ে আছে। লড়াই। লড়াই সেও এক গন্তব্যে যাওয়া।

কিন্তু যে বিবেকের আড়ালে, জ্ঞানের আড়ালে, আলোর আড়ালে আরো আলো হয়ে রয়েছে তার প্রত্যহের যে বিকিরণ যে শিখার বিচ্ছুরণ তা প্রকাশ্যের অহংকে – ঔদ্ধত্যকে – কিছুটা হলেও স্তিমিত করে।

আমাকে যে আড়াল করছে তাঁকে ধন্যবাদ। আমি যাকে আড়াল করছি নিজের স্বার্থে নিজেকে প্রচারের স্বার্থে তার জন্য নিজেকে ধিক্কার নিজেকে নিন্দা ...আত্মনিন্দা আত্মসমালোচনা অনেক দূর অব্দি দেখতে সাহায্য করে। দূরে ঐ আকাশ, বিরাট আকাশ, নিজের কথা কোনোদিন সে বলেনি, বলেনি আমাকে দেখো, সে চুপচাপ এক শূন্যতায় নতুন সুর দিয়ে তাকে ভরাট করছে।

ঘরের এককোণে যে হারমোনিয়াম নীরবে একা পড়ে আছে দৃষ্টির আড়ালে, সে স্তব্ধ। কিন্তু তাকে বাজালেই সে আড়ালের ভিতরের আড়ালকে উপাসনায় ধ্যানে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যায় আমাদের। ধ্যানের নতুন দিগন্ত মানে বিন্দু, ঐ বিন্দু এক পাখি, এক জ্ঞানীর অনন্ত সরোবর। যা শীতল শান্ত কিন্তু সে বহুদূরগামী পথ, অনেকদূর যাওয়ার রাস্তা সে।   


মন্তব্যসমূহ

Unknown বলেছেন…
লেখাটা মনে হল প্রচন্ড গরমের মাঝে পুকুরে ডুব দিয়ে কিছু শীতলতা কুড়িয়ে পেলাম।
রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন…
মায়া অবয়বে জমেছে কয়েক ফোঁটা জল...কোন চোখ খুঁজে পায়নি ব'লে এযাত্রা অশ্রুর নিয়তি অস্পর্শ থেকে গেল। শব্দের ঘর সংসার জুড়ে বেজেই চলেছে প্রিয় রাগিনীর মোহহ্রদে ছলাৎ ছল, কে যেন ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায় সাধ, সাধ্যের সীমানা পেরিয়ে দেখি মেঘ করে এসেছে আকাশে, এসময় আমার ইচ্ছে করে ঠোঁট ছোঁওয়াই প্রিয় বাঁশিখানায়, গবাধিরা ফিরে আসুক একা, আমায় একা হওয়ায় পেয়েছে, একহন পথ চিনিয়ে দিয়েছে...সে পথে সোজা হেঁটে গেলে আকাঙ্খার গঞ্জে দেখা হবে তোমার আমার...সেই সুর ভুলে যাওনি তো!

আপনার অসাধারণত্বকে আমার মিডিওক্রেসি দিয়ে মেপে নিতে পারার কোন প্রকরণই জানা নেই, শুধু অনিঃশেষ মুগ্ধতা রেখে গেলাম। ভালো থাকবেন।
দেবাঞ্জন দাস বলেছেন…
সৌন্দর্যের প্রতি, স্নিগ্ধতার প্রতি এই প্রায় শিশুসুলভ বিস্ময় নিয়ে দেখা, এ্যাপ্রোচ -- মুগ্ধ করে।

জনপ্রিয় লেখা